অন্নহীন হয়ে তবু বাহিরে বের হতে পারবেন বস্ত্রহীন ভাবে নয়। আর বাহিরে যদি বের হতে না পারেন তবে অন্ন বা অন্য কোন কিছুর সন্ধানই সঠিকভাবে করা সম্ভব না। আর যারা আপনাকে আপনার এই অতীব প্রয়োজনীয় বস্ত্রের প্রয়োজন মিটাচ্ছেন তারাই সূচশিল্পী গার্মেন্টস কর্মী। তাদের হাতের শৈল্পিক ছোঁয়ায় বিচ্ছিন্ন কাপড়গুলো হয়ে ক্রমেই হয়ে উঠে আপনার আব্রু। আপনার ছোট্ট সোনামনির তুলতুলে সোয়েটার, আপনার উদ্যমী ছেলে মেয়ের ফ্যাশনেবল টিশার্ট, আপনার ধার্মিক মা বোনের পবিত্র পর্দা।
তাদের অবদান ঠিক কতটুকু তা আমাদের অর্থনৈতিক সমীক্ষাতেও স্পষ্ট। দেশের সবচেয়ে বেশি ৪০.৬% জনশক্তি কৃষিতে নিয়োজিত হয়েও তাদের অবদান যেখানে ১১.৫% সেখানে শিল্পে তার অর্ধেক জনশক্তি (২০.৬%) নিয়ে অবদান তার দ্বিগুন ২০.৪%। আর বাংলাদেশের শিল্পকারখানার যে সিংসভাগই গার্মেন্টস শিল্প তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
এই গার্মেন্ট শিল্পীরাই কাপড় জোড়া দেওয়ার সাথে সাথে জোড়া দিচ্ছে আমাদের দেশকে বিদেশের বড়বড় শক্তিধর দেশের সাথে। আমাদের দেশ ক্রমে ক্রমে যাচ্ছে উন্নতির দিকে। কিন্তু যাদের অবদানে এ উন্নয়ন তাদের উন্নয়ন হচ্ছে কি? কারখানার ভিতরে বাইরে নিরাপদ পরিবেশ তারা পাচ্ছে কি?
টি এস ইলিয়টের “April is the cruelest month” লাইনটা হয়তো আমরা ভুলে গেছি সাথে সাথে ভুলে গেছি ১০ বছর আগে এপ্রিলে ঘটা সাভারের রানা প্লাজার ঘটনা। ভুলে গেছি সেখানে মারা যাওয়া মানুষদের। তাদের পরিবারদের। তাদের দাবিগুলো।
সব দোষীদের পরিচয় এখনো জনগণের সামনে আসেনি। ভবন মালিকসহ দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়নি। রানা প্লাজায় নিহত শ্রমিকের প্রতিনিধি ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি এত কম যে তা দিয়ে তাদের মৌলিক অধিকারই পূরন হয় না। অন্তত তিনবেলা খাবার, পোশাক, মাথা গোঁজার ঠাঁই, অসুস্থ হলে চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষার ব্যবস্থাই হয়না ৷ বৃদ্ধ বয়সের জন্য সঞ্চয়, অতিথি আপ্যায়ন ও বিনোদনের কথাতো চিন্তাই করা যায় না।
অধিকাংশ মহিলা কর্মী এখন সন্তান নিতে ভয় পায় কারন তার বাচ্চাকে দেখাশুনা করতে হলে যে অতিরিক্ত লোক, জায়গা, খাবার তা তার সাধ্যের বাইরে। অধিকাংশ ছোট বাচ্চাদের তাই গ্রামে আত্মীয় স্বজনদের কাছে রেখে এসে কাজে যুক্ত হতে হয়। যা তাকে মানুষিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
একজন মানুষের গড়ে ২৫০০ থেকে ৩০০০ কিলোক্যালোরি তাপ উৎপাদনের উপযোগী খাবার খেতে হয়। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষনা অনুযায়ী ঢাকায় বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের খাবার খরচের জন্য মাসিক ২২ হাজার ৪২১ টাকা প্রয়োজন হচ্ছে। আর কোনো মাছ-মাংস না খেলেও খাবার বাবদ খরচ হচ্ছে ৯ হাজার ৫৯ টাকা যা তার নূন্যতম মুজুরীর থেকেও বেশি। ফলে সে এই গড় ক্যালোরি গ্রহন করছে না। ফলে শারীরিক ভাবেও দূর্বল করছে। তাছাড়া পরিবারকে সাপোর্ট দিতে অতিরিক্ত সময় কাজ করছেই কারন তাকে শুধু খাবার খেলেই হয়না।
সামাজিকভাবেও তারা নিরাপদ না। এখনো তাদের হীন চোখে দেখা হয়। তাছাড়া একজন মানুষ বয়স্ক হয়ে যাওয়া, চাকরি না থাকা, অসুস্থ হওয়া, নারীদের গর্ভকালীন স্বাস্থ্যের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন কারণে সামাজিক নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়।
কর্মীদের যাতায়াত পথও নির্বিঘ্ন নয়। রানা প্লাজার সাভার এলাকার আসেপাশেই এখনো বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকরা হেনস্তার শিকার হয়। চুরি ডাকাতির পাশাপাশি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। এভাবে ধীরেধীরে শারীরিক মানুষিক মৃত্যু বা আকস্মিক মৃত্যুর মিছিল থামা দরকার।
২০২৬ সালে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে ঢুকব। এ সময়ের মধ্যে অনেক অনেক সূচকের মধ্যে যাদের অবদানে এই উন্নতি তাদের সকল সূচকের উন্নতি করতে হবে।
ঊজ্জ্বল হাসান
মতামত লিখুন :