মোঃ ওয়ালিদুর রহমান বিদ্যুৎ: আমি আমার ক্যারিয়ার শুরু করেছি একটু দেরীতে। ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায়-দুটোই। আমার এখনো মনে আছে দীর্ঘ ১ বছর ৪ মাস ৯৩টি আবেদন করার পরে ৬৩ তম আবেদনটির বিপরীতে আমি প্রথম চাকরী পাই ও শুরু করি। অবশ্য ৪০ বা ৪৫তমটিতেও জব হয়েছিল। মার্কেটিং জব ও মাস্টার্স শেষ না হওয়ায় করিনি।
এই সময়কালে চাকরীর বাজারের ভয়ানক অবস্থা, ফ্রড, প্রতারনা, ধান্দাবাজি, হৃদয়হীন আচরন, বড়দের সীমাহীন অবহেলা, উন্নাসিকতা, হেল্প না করার প্রত্যক্ষ শিকার আমি। এই কথাগুলো এজন্য শুরুতে বললাম, আজ ১২ বছর পরে আমি যখন ক্যারিয়ার সচেতনতা, প্রস্তুতি নিয়ে কিছু লিখি, কিছু সমালোচক কঠোরভাবে এই বলে সমালোচনা করেন, “নিজে তো ওই বিপদে নেই, তাই বুঝবেন না”, “নিজে বড় পজিশনে থেকে বড় বড় কথা বলাই যায়”, “কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কীসে”-ইত্যাদি। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আমি নিজে আকাশ হতে পড়িনি।
চাকরীর বাজারের একজন সাবেক উমেদার এই আমি আর দশজন চাকরী খোঁজা বেকারের মতোই সবরকম ঘাটের পানি খেয়েই উপরে উঠেছি। কোনো অভিজ্ঞতাই আমার বাদ যায়নি। আর আমরা যখন সেই এক যুগ আগে চাকরীর বাজারে নাম লেখাই, তখনকার দিনে জব হান্টিং বরং আজকের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ছিল। তার সবচেয়ে বড় কারন, তখন হাতের মুঠোয় ইন্টারনেট ছিল না। যাহোক, একজন বেকার বা চাকরীর খোঁজে থাকা মানুষের জীবন আমি খুব হৃদয় দিয়েই বুঝি। তাই আমাকে ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই।
তবে আজকের লেখার উদ্দেশ্য সেটা না। আজ আপনাদের জানাতে চাই, আজকাল চাকরীর বাজারে কী কী ফ্রড বা প্রতারনা হয়। সেটা জানা থাকলে আপনি সতর্ক হতে পারবেন।
১.বিশেষভাবে মেয়ে প্রার্থীদের সাথে মেনটাল এ্যাবিউস, হ্যারাসমেন্ট, পারভারশন, ট্র্যাপিং প্রচুর হয়ে থাকে। অসময়ে, ছুটির দিনে কিংবা রিমোট লোকেশনে ইন্টারভিউ ডাকা হলে সতর্ক হোন। সম্ভব হলে একজন সঙ্গী বিশেষত পুরুষ সঙ্গী নিয়ে যান।
২.সিভি চেয়ে যে ডাকেনা এমন প্রচুর ঘটনার সাক্ষি আমি নিজে। আমার কাছে প্রচুর মানুষ প্রার্থীদের সিভি চান। আমি সিভি দেবার পরে তাদের আর কখনো ডাকেনি-এমন প্রচুর ঘটনা আমি দেখেছি। নাম রক্ষা, মুখ রক্ষা, নিয়ম রক্ষা, আইনী ঝামেলা এড়ানোর জন্য অনেকেই সার্কুলার দেন। কিন্তু ফাইনালি তারা নিজেরাও জানে লোক তারা নেবে না। আমি প্রায়ই বেশ কিছু যায়গা হতে প্রার্থী দেবার অনুরোধ পাই। তাদেরকে প্রার্থীদের সিভি দিই। খুব বিরক্তি ও ঘৃনা নিয়ে আমি দেখেছি, বেশ কিছু সংখ্যক প্রতিষ্ঠান সিভি নেবার পরে, কিংবা এমনকি ইন্টারভিউ হয়ে যাবার পরে আমাকে জানিয়েছে, ভাই, ওই পদে লোক নেয়া হবে কিনা-কোম্পানী সেটা আবার ভাবছে। সেটা শেষ পর্যন্ত দাড়ায়, নিয়োগ বাতিলে। মাঝখান হতে বেশ কিছু লোক ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে হয়রানি, অর্থ, সময় ও মেন্টালিটির ক্ষয়। আপনি যদি নিজেই শিওর না হন, আপনার লোক লাগবে, কেন আপনি সার্কুলার দেন?
৩.আরেকটি অদ্ভুৎ প্রতারনার ধরন বলি। বিশেষভাবে দেয়ালে সাঁটানো সস্তা বিজ্ঞাপন দেখে প্রতারিত হবার নজির প্রচুর। আমি নিজে একবার অমন একটি চাকরীর বিজ্ঞাপন দেখে (ইচ্ছা করেই) গিয়েছিলাম। ফলাফল অনুমিতই ছিল। তারা যথারীতি প্রচুর প্রার্থী পেয়েছে। দেখলাম সবাইকেই একই রুমে একইভাবে গণ-ইন্টারভিউ করছে। মানে ওই আরকি? টেবিলের সামনে বসিয়ে বয়ান দিচ্ছে। তারপর বলছে, “আপনি কাল জয়েন করবেন। কাগজপত্রসহ আসবেন। শুধু আপনার রেজিষ্ট্রেশন ও কার্ড বানাতে ২০০০ টাকা লাগবে। সেটা পেমেন্ট করে যান।” আমি নিজে দেখেছিলাম। বহু কষ্টে বের হয়েছিলাম টাটা জানিয়ে। জেনে রাখুন, সরকারী চাকরী বাদে কোথাও, যেকোনো ধরনে যদি পেমেন্ট চায়, বিনা বাক্যব্যয়ে টাটা জানিয়ে বের হয়ে যাবেন। নিশ্চিৎভাবেই ওরা ফ্রড।
৪.টিউশনী পাইয়ে দেবার প্রচুর মিডিয়া আছে ঢাকাসহ বড় বড় নগরীতে। আমি নিজে ওই বিজ্ঞাপন দেখে আজিমপুরে এক অখ্যাত অফিসে গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস আমার বন্ধু সাথে ছিল। আমি ওইবারে একদল মাদক পাচারকারীর হাতে প্রায় পড়েছিলাম। রগরগে বা চকচকে বিজ্ঞাপন দেখে ভুলবেন না। আর মনে রাখবেন, ভাল জব কিংবা ভাল টিউশনীর বিজ্ঞাপন দেয়ালে দেয়ালে ঘোরে না। সতর্ক হোন।
৫.একবার কারওয়ান বাজারের টিকে টাওয়ারের এক অফিসে গেলাম। (যথারীতি দেয়ালের না যেন পত্রিকায় চিকামারা বিজ্ঞাপন দেখে)। এই প্রতারনাটির শিকার হয়েছেন আমার আজকের প্রচুর বড় বড় প্রোফেশনাল বন্ধুরাই যারা ওই সময়ে চাকরীর বাজারের অসহায় উমেদার ছিলেন। গিয়ে দেখি একটি হল রুমে ইয়োগা, হৈ হৈ, মোটিভেশন স্পিচ নামে নানান কান্ড চলছে। সেটা শেষ হবার পরে একলোকের সাথে আমাকে দিয়ে দেয়া হল। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন বারিধারায়।
আমি সবটাই বুঝছিলাম। স্রেফ অভিজ্ঞতা নেয়া আর শেষতক দেখে নেবার মানসিকতা হতে সাথে থেকে গেলাম। ভদ্রলোক (তিনি নিজেও একজন অসহায় মানুষ ছিলেন), মলিন পোষাকে টাই বেঁধে প্রায় অর্ধেক বেলা প্রচন্ড রোদে ঘুরে ঘুরে, নানা অফিসে গিয়ে তার ৯টি বইয়ের একটি বিরাট (হাস্যকর এনসাইক্লোপেডিয়ার) সেট বিক্রী করতে চেষ্টা করলেন।
আমি তার সাথে প্রায় ঘন্টা তিনেক কাটালাম। তিনি একটি বইও গছাতে পারলেন না। ওই ধরনের প্রতিষ্ঠান নাকি আজও আছে। তাদের খপ্পরে যেন না পড়েন। কমপ্লিট ফ্রড।
৬.মূল সার্টিফিকেট জমা রেখে কিংবা বন্ড নিয়ে চাকরীর অফার করে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান। হ্যা, সার্টিফিকেট জমা রাখা বা বন্ড নেয়া মানেই সেটা অন্যায় কিংবা সব প্রতিষ্ঠান খারাপ-তা নয়। আইন ও আইনি ভাষা ও নিয়ম এক জিনিস, আর বাস্তবতা ও ফিল্ড সিনারিও ভিন্ন জিনিস। তাই বিষয়টাকে আইনের দৃষ্টিতে না দেখে আমি বাস্তবতার দৃষ্টিতে দেখি। বিশেষত দেশে যখন ৪.২০ কোটি বেকার, তখন আইনের দোহাই জব দিতে পারবে না। হ্যা, বন্ড সাইন করলে আপনি প্রচুর ঝামেলায় পড়তে পারেন। তবে ওই বন্ড সাইন করলেও আপনাকে বন্ড দিয়ে আটকাতে বা আইনিভাবে দন্ড দিতে পারবে না। কিন্তু ঝামেলাতো করতেই পারবে। আর সেটাই তো আপনার জন্য বিশাল বিপদ। দন্ড হবার আগেই আপনি ভুগে শেষ। তাই ৯০% কেসে বন্ড দেবেন না।
হ্যা, যদি প্রতিষ্ঠান ভাল হয়, প্রাকটিস ভাল হয়, স্বভাব ভাল হয়, পেমেন্ট ও কালচার ভাল হয়, বন্ড দিয়ে চাকরী করতে পারেন। এটা বাস্তবতা। ৯০% প্রতিষ্ঠানই সেই ভাল ক্যাটেগরীতে নেই। আপনি যদি বাকি দুর্লভ ১০% এর কোনোটাতে পান, তবে জয়েন করতে পারেন। কিন্তু কিছু কিছু মানহীন বা ধান্দাবাজ প্রতিষ্ঠান আছে। তাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর না নিয়ে সার্টিফিকেট দেবেন না।
৭.খুব বিশ্বাস হবে না হয়তো, তবু বলছি। কিছু ধান্দাবাজ প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তি আছে, যারা বিশেষত মহিলা প্রার্থীদের সিভি ও ছবি নিয়ে নানারকম ধান্দা করে। এমনকি ছবি নিয়ে ব্লাকমেইল করার নজিরও আছে। সিভির ফোন নম্বর নিয়ে হ্যারাস করা, বিরক্ত করা, ট্রাপ করার অভিযোগ আছে। মেয়েরা সতর্ক হোন। চাইলেই যেকোনো চাকরীদাতাকে সিভি, ছবি দিয়ে বসবেন না। বিশেষত কোনো জব প্রোভাইডার যদি ফেসবুক আইডি চান, দশগুন সতর্ক হোন।
আমি আমার সাথে লিংকড থাকা প্রার্থীদের একটি ডাটাবেস মেইনটেইন করি সেখানে প্রত্যেকের ফেসবুক/লিংডইন প্রোফাইলের লিংক থাকে। কিন্তু তার সবাই আমাকে খুব ভাল করে চেনেন। আর সেটা করা হয় দ্রূত প্রার্থীদের মেসেঞ্জারে এটেন্ড বা জব লিংকিং সার্ভিস দিতে। কিন্তু সবাই সেটা ভালভাবে ব্যবহার করবে-সেই গ্যারান্টি নেই। তাই সতর্ক হোন।
৮.আপনি খুব অবাক হবেন জেনে, অনলাইন জব পোর্টালে থাকা আপনার সিভি ও সিভির তথ্য বিক্রী হয়। বিশ্বাস হচ্ছে না? খোঁজ নিন। জেনে যাবেন। বিভিন্ন জব পোর্টালের লোকের সাথে কথা বলে দেখুন। আপনার অনুমতি বা অজ্ঞাতেই আপনার অনলাইন প্রোফাইল/সিভি বিক্রী হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে, থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠানের কাছে। কখনো কখনো জবের জন্যও অবশ্য আমরা এমপ্লয়াররা সিভি ব্যংক হতে সিভি নিই। কিন্তু তার বাইরেও সিভি/তথ্য বিক্রী হয় নানা কাজে যা অনৈতিক। আপনার জব পোর্টালের প্রোফাইল/সিভি হতে যদি ম্যাট্রিমনি সাইটের জন্য তথ্য বিক্রী হয়, সেটাকে কী বলবেন?
৯.ইন্টারভিউ দেবার পরে প্রার্থীকে বিশেষত নারী প্রার্থীকে ব্যক্তিগতভাবে কল করা, সম্পর্ক সৃষ্টির প্রস্তাব, নানা টোপ, প্রলোভন, চাকরীর বদলে প্রাপ্তির দাবী-এমন করার নজির আছে। না হলে তো ভাল। হচ্ছে ও হবে। তাই নিজের করনীয় ঠিক করুন।
এতক্ষন ধরে এত ফ্রডের কথা শুনে আপনি কী ঠিক করলেন? চাকরীর আবেদন করাই ছেড়ে দেবেন?
না, তা করবেন না। আমি শুধু বলছি, সতর্ক হোন। সাবধানের মার নেই।
লেখক: এইচআর-এডমিন পরামর্শক/ক্যারিয়ার কাউন্সিলর/লেখক
মতামত লিখুন :