Logo

বস/ম্যানেজারকে কী করে ম্যানেজ করবেন?

RMG Times
শনিবার, মার্চ ৩১, ২০১৮
  • শেয়ার করুন

ওয়ালিদুর রহমান: কিছুদিন আগে ’কর্পোরেট রঙ্গ’ নামে একটা ফিচার লিখেছিলাম। লেখাটির শেষাংশে বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত কর্পোরেট লাইফের নানা গ্রীভ্যান্স এর একটা বিবরণ দিয়েছিলাম। ওই গ্রীভ্যান্স এর সিংহভাগই ছিল বস বা এমপ্লয়ারের নামে নানা অভিযোগ, অনুযোগ, ক্ষোভ, হতাশা, শ্লেষ ইত্যাদি। যদিও একটি ফেসবুক পোস্ট বা সাধারণ আর্টিকেলের ফিডব্যাক হতে প্রাপ্ত তথ্য হতে এটা নিশ্চিৎভাবে বলা যায় না যে ঢালাওভাবে বাংলাদেশের কর্পোরেটের বাসিন্দারা খুব বাজে অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন, তবু আমার এক যুগের অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন সূত্র হতে পাওয়া তথ্যের আলোকে আমার মনে হয়েছে, কর্পোরেটে বিদ্যমান বঞ্চনা ও ক্ষোভের পরিমানটা যথেষ্ট এলার্মিং এবং আমলে নেবার মতো। তার আছে নানা ইতিহাস, ব্যাখ্যা, ডাইমেনশন ও কারণ। তবে আজ একটি বিপরীত দিক বলব। কর্পোরেট মানে শুধু জুনিয়র বা সাবোর্ডিনেটদের প্রতি বস, সিনিয়র, টীমলিডার বা এমপ্লয়ারদের এপ্রোচ নয়। এই অচলাবস্থা ও গুমোট নিরসনে সিনিয়রদেরই মূখ্য ভূমিকা যদিও আছে, তবে সেই সাথে জুনিয়র বা সাবোর্ডিনেটদের হাতেও আছে কিছু করনীয়। তারা কীভাবে এই সেগমেন্টে কাজ করতে পারেন, তা নিয়ে কথা বলব আজ। বিষয়টাকে স্রেফ এমন ভাবলে ভুল হবে যে, সম্ভবত আমি বোঝাতে চাইছি, কীভাবে বসকে ম্যানেজ করবেন। না, ওটি আমার লেখার অন্যতম উপজীব্য হলেও, তার সাথে আরো কিছু বিষয়ে আমি আলোকপাত করব।

একটি প্রতিষ্ঠানে সবরকম কর্মী থাকে। অর্গানোগ্রাম চার্টের একদম উপর হতে নিচ পর্যন্ত বিভিন্ন লেয়ারে বিভিন্ন স্ট্যাটাসের কর্মী রাখে প্রতিষ্ঠান। অর্গানাইজেশনাল ট্রির নিচের সারির কর্মীরা সবসময়ই অভিযোগ করে থাকেন, তাদেরকে তাদের বসেরা বা লিডাররা নানাভাবে বঞ্চিত করেন, হতাশ করেন, মিসবিহ্যাভ করেন, হয়রানি করেন, অবমূল্যায়ন করেন, স্বজনপ্রীতি করেন, পক্ষপাতিত্ব করেন, ক্রেডিট বঞ্চিত করেন। মেধায় অবমূল্যায়ন ও যোগ্যতার মূল্যহীনতার অভিযোগতো হাজার হাজার। তাছাড়া টীম লিডারের অযোগ্যতা ও খামখেয়ালীতে জুনিয়র টীমমেটদের ভাগ্যহীনতা ও ক্যারিয়ারের ক্ষতির ভুড়ি ভুড়ি অভিযোগ আসে। মাঝখানে পড়ে জুনিয়র কর্মীদের ত্রাহি মধুসুদন অবস্থা। তারা না পারেন বসকে কিছু বলতে, না পারেন সহ্য করতে। এখন এর সমাধানের জন্য যতরকম টোটকা কিংবা অভিজ্ঞ পরামর্শ ক্যারিয়ার কাউন্সেলররা দিয়ে থাকেন তার বেশিরভাগটাই দেখা যায় সেই সিনিয়রের ভাগেই বাস্তবায়নের দায় থাকে। এখন প্রশ্ন হল, যাকে নিয়ে সমস্যা, তিনি তো ওসব বড় বড় আর্টিকেল পড়ে নিজেকে সংশোধন করার দায়টা অনুভব করবেন না। আবার পরিবর্তনও তো দরকার। সেক্ষেত্রে ওই ভাগ্যাহত জুনিয়ররা এই দুঃসহ অবস্থা হতে বের হতে ধাপে ধাপে কী করতে পারেন-সেটাই বলার চেষ্টা করছি আজ।

১.যেকোনো অবস্থা সামাল দেবার জন্য প্রথমেই যেটা করা দরকার সেটা হল, সমস্যা বা পরিস্থিতিটিকে স্ট্যাডি করা। নির্মোহ স্ট্যাডি। আপনি যেই ব্যাপারে আপনার বস বা ম্যানেজারের কাছ থেকে সমস্যা বা বঞ্চনার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে মনে করছেন, সেই বিষয়টার একাডেমিক ও এনালিটিক্যাল স্ট্যাডি করুন, তার ধরন, কারন, হিস্ট্রি ও সমাধান নিয়ে স্ট্যাডি করুন। শুধু কপাল চাপড়ালে তো আর ঝড় বন্ধ হয় না।

২.পরিস্থিতির সাথে সাথে সিনিয়রকে স্ট্যাডি করা। তার কাজ, কাজের ধরন, লোড, ক্ষমতা, তার ব্যাকগ্রাউন্ড, ক্যারিয়ার রেকর্ড, পছন্দ, অপছন্দ, বিহ্যাভিওরাল প্যাটার্ন, ক্রিটিক্যাল থিংকিং প্রসেস, রিএ্যাকশন প্যাটার্ন, রিফ্লেক্স লেভেল-এই বিষয়গুলো নিয়ে বস বা সিনিয়রকে নিবিড়ভাবে একটু স্ট্যাডি করুন। তাকে বুঝতে চেষ্টা করুন। না ‍বুঝে অন্ধের মতো তলোয়ার চালালে নিজেই কুপোকাত হবেন। তাই ধাপে ধাপে এগোন।

৩.নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে একটি নিরপেক্ষ কমপারেটিভ এনালিসিস করুন। আমি বলতে চাই, জবের যেই কষ্টকর বা সমস্যাগ্রস্থ অংশ নিয়ে আপনি চিন্তিত বা যেটা আপনাকে বাধ্য করছে, নতুন একটি চাকরী পাবার চেষ্টা করতে, সেই অংশটিকে একটু ক্রিটিক্যাল এনালিসিস করুন। আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে এই লেখাটি:

৪.নিজের কাজ, দায়ীত্ব, নিজের প্রাপ্তি, ক্যারিয়ার ও তার বিপরীতে সমস্যার মাত্রা নিয়ে ভাবুন। সমস্যাটির সমাধানের একাধিক একাধিক বিকল্প বের করুন। টপ হতে বটমের দিকে পুরো টীমকে নিয়ে কাজ শুরু করুন।

৫.একজন প্রোফেশনাল ক্যারিয়ার কাউন্সেলরের সাহায্য নিন। 

৬.জুনিয়ররা মিলে একটি প্ল্যাটফরম করতে পারেন। ঐক্যবদ্ধ হোন। কিছু করার আগে নিজেদের ঐক্যবদ্ধতার পরীক্ষা নিয়ে নিন। যেন মাঠে নামলে সবাই এক থাকবেন-সেটা নিশ্চিত থাকা যায়।

৭.বস/ম্যানেজারের সুপেরিয়রের সাথে সম্পর্ক তৈরী করুন।

৮.প্রোএ্যাকটিভ হোন। বস/ম্যানেজার কিছু করে বসার আগে আপনিই তার কাছে একটা পরিস্থিতি পরিবেশন করুন। পরিস্থিতি সৃষ্টি করুন। অবশ্যই পজিটিভ সিচুয়েশন। সাবোট্যাজ নয়।

৯.বসের সাথে সব সাবোর্ডিনেটদের ওয়ান টু ওয়ান রিলেশন/ডিলিংস কমাতে ডিজিটাল মাধ্যমের সাহায্য নিন। হোয়াটসএ্যাপ, ভাইবার বা ইমোতে অফিশিয়াল গ্রূপ বানিয়ে সেখানে নিজেদের কাজ, চিন্তা, সমস্যা, সমাধান, পরামর্শ, কর্পোরেট কালচার সম্পর্কিত মেসেজ, আর্টিকেল, নীতি, নিয়মের বিষয়ে লেখালেখি, শেয়ারিং করুন।

১০.গ্রূপ স্ট্যাডি, গ্রূপ ট্যুর, গ্রূপ পিকনিক, আউটিং, মান্থলী প্রেজেন্টেশন হতে পারে সম্পর্ক উন্নয়ন ও বসকে মাটিতে নামিয়ে আনার কিছু কার্যকর উপায়।

১১.সবসময় বস অর্ডার করলেই শুধুমাত্র কোনো উদ্যোগ নেবেন কিংবা মূল সিদ্ধান্ত বসকেই নিতে দেবেন-এমনটা না করে বরং নিজেরাই প্রতিটি প্রস্তাব, প্রকল্প বা ইস্যূতে নিজেরা কয়েকটি অল্টারনেটিভ ঠিক করে বসকে শুধু চুজ করতে দিন বেস্ট বিকল্পটিকে। তাতে তার স্বেচ্ছাচারিতার ক্ষেত্র কমে আসবে।

১২.বসের/ম্যানেজারের সব অর্ডার, ইনস্ট্রাকশন, সিদ্ধান্ত লিখিত করার ব্যবস্থা নিন কৌশলে-চিঠি বা মেইলের মাধ্যমে। ফলে তিনি যেকোনো কিছু অন্যরকম বা ইচ্ছেমাফিক চাপিয়ে দিতে পারবেন না।

১৩.মাঝে মধ্যেই পুরো টীম একসাথে বসের রুমে যান, চা অফার করুন, তার জন্য একটি অফিস পার্টি দিন। তিনি সংকোচে পড়ে যাবেন। তাছাড়া হতে পারে, সেই বেচারাও অনেক রকম ফ্রাস্ট্রেশন, বঞ্চনা, স্ট্রেসের মধ্যে আছেন। না বুঝেই হয়তো তাকে গিলোটিনে চড়াচ্ছেন আপনি।

১৪.বসের থেকে কাজের লোড নিয়ে নিন। তাকে এমনটা বোঝান যে, তিনি অনেক লোড নিজের কাঁধে নিয়ে রেখে কষ্ট করছেন। আপনারা সেটা কমাতে চান। লোড কমাতে গিয়ে তিনি কিছু কর্তৃত্বও হারাবেন।

১৫.টীমের বার্ষিক বা ষান্মাসিক রিপোর্টের ব্যবস্থা নিন। রিপোর্টিং জবাবদিহীতা বাড়ায়।

১৬.সাহস রাখুন। বস/ম্যানেজারের স্বেচ্ছাচারিতা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সরব হোন। একদম ইন্ট্রোভার্ট না থেকে ভোকাল হতে শিখুন। তবে কখনোই তাকে ইস্যূ তৈরীর সুযোগ রাখবেন না। ফাঁকফোঁকর বন্ধ রাখবেন। আপনাকে আগে নিশ্চিৎ হতে হবে যে, আপনার ভুল বা ত্রূটি ধরার কোনো সুযোগ ম্যানেজারের জন্য আপনি রাখেননি।

১৭.বসকে শত্রূ ভাবার চিরাচরিত প্রথায় বিশ্বাস করা বন্ধ করুন। তাকে কাছে টানুন। তিনি না চাইলেও। আর জেনে রাখুন, আপনার কল্পনা বা স্বপ্নে দেখা আদর্শ বস কখনোই আপনি পাবেন না। ত্রূটি ও বিচ্যুতি থাকবেই। তাই কমপারেটিভ চয়েজে বিশ্বাস করুন।

১৮.ইগো, উগ্র পার্সোনালিটি এবং হামবড়া ভাব পরিত্যাগ করুন। হাসিমুখ, ধন্যবাদ, স্যরি, কনগ্রাচুলেশনস, গ্রেট-এই কথা ও কাজগুলোতে অভ্যস্ত হোন। আমরা বাঙালীরা একটু সংকুচিত স্বভাবের। এই কথাগুলো অনেক সম্পর্ককেই সহজ করে দেয়। আমরা এগুলো করতে বা বলতে গেলে যেন জিহবা জড়িয়ে যায়।

১৯.অফিসে যেকোনো প্রকারে একটি কমপ্লেইন বক্স ও আইডিয়া বক্সের উদ্যোগ নিন। গোপনে কমপ্লেইন বক্সের ব্যবহার হতে পারে এক্সট্রিম বস/ম্যানেজারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার শেষ নিরাপদ সমাধান।

আর সবশেষে বলব, আপনি যদি এতসব ঝামেলায় না যেতেই চান কিংবা ভাবেন, আমার ঠেকা পড়েছে এত হ্যাপা সহ্য করতে, তবে ছেড়ে দিন অমন চাকরী। আর খুঁজে নিন আপনার মনের মতো কোনো জব। তবে মনে রাখবেন, পৃথিবী গোল আর সবখানকার বাতাসেই অক্সিজেন আছে।


লেখক : HR/Admin পরামর্শক, ক্যারিয়ার কাউন্সেলর, লেখক।