Logo

অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের প্রয়োজন নেই : বাণিজ্যমন্ত্রী

RMG Times
বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৫, ২০১৭
  • শেয়ার করুন

ডেস্ক রিপোর্ট : ২০১৮ সালের মেয়াদ শেষ হবার পর বাংলাদেশে অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার কোনো প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেছেন, রানা প্লাজা ধ্বসের পর আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশ একটা মর্যাদাহীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু গত সাড়ে চার বছরে সেই ক্ষত আমরা দূর করতে সক্ষম হয়েছি। ইতিমধ্যে দেশের সব পোশাক কারখানা পরিদর্শন শেষ হয়েছে। এখন রেমিডিয়েশন কাজ শেষের পথে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ পোশাক রফতানিকারক দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। সবচেয়ে ব্যয়বহুল সবুজ কারখানার সংখ্যা আমাদেরই বেশি। বাংলাদেশ বিশ্বের সবুজ কারখানার প্রতিযোগিতায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। শীর্ষ দশটির মধ্যে সাতটিই বাংলাদেশে। এরপর তারা আর কী ইন্সপেকশন করবে?

পোশাক শিল্পের বর্তমান ও করণীয় শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বুধবার প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী এসব বলেন। রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। এতে নৌপরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এসডিজির মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ, এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ড. ম তামিম, সিপিডির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরসহ পোশাক খাতের শীর্ষ নেতারা বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, দেশের পোশাক খাত নিয়ে বহুমুখী ষড়যন্ত্র হচ্ছে। যেদিন এ খাতে ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, সেদিন থেকেই পোশাক খাত নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। কারণ এখানে অনেক প্রতিযোগী দেশ আছে। তাদেরও এ ক্ষেত্রে স্বার্থ জড়িত। তারা তাদের স্বার্থের ব্যাপারে আপস করে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশেরই কিছু নাগরিক। দেশে একটা কিছু ঘটতে না ঘটতেই এবং সেটা সরকার জানার আগেই বিদেশিরা জেনে যাচ্ছে। এ জাতীয় নানা দুর্বলতার কারণেই এত উন্নতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের পোশাকের ন্যায্যমূল্য মিলছে না। অথচ আগের অর্থবছরের তুলনায় সদ্যবিদায়ী অর্থবছরে পরিমাণের দিক থেকে প্রায় দ্বিগুণ পোশাক রফতানি হয়েছে।

এ সময় পোশাক খাত নিয়ে দেশের প্রচারমাধ্যমগুলোর সমালোচনা করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই পোশাক খাতে দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সেগুলো তাদের দেশের গণমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করে না নিজেদের স্বার্থেই। এ কারণে টুইন টাওয়ার দুর্ঘটনায় ঠিক কতজন মারা গেছে, তার সঠিক তথ্য কেউ জানতে পারেনি। এমনকি নিহতদের মরদেহের ছবিও কেউ দেখাতে পারেনি। একই ঘটনা সম্প্রতি ঘটে যাওয়া লাসভেগাসের সন্ত্রাসী হামলায়। সেখানেও নিহতদের ছবি গণমাধ্যমে ঢালাওভাবে আসেনি। অথচ রানাপ্লাজা দুর্ঘটনার দৃশ্য ও নিহতদের ছবি ১৭ দিন ধরে লাইভ প্রচার করেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। তফাৎটা হল আমরা আমাদের স্বার্থ নিজেরাই সংরক্ষণ করতে পারি না। পোশাক শিল্পে অনেক সংস্কার হয়েছে। একটি কারখানাকে নতুনরূপে সাজাতে সর্বনিন্ম ৫ কোটি টাকা থেকে ২০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এরপরেও আমেরিকাসহ বিভিন্ন বন্ধুরা আমাদের ব্যাপারে নেতিবাচক দেখে। আমরা মাত্র ১ বছরের মধ্যে শ্রমিক আইন করেছি। অথচ আমেরিকার এটা করতে প্রায় ২৬ বছর লেগেছে। তাদের মাত্র ৩০ শতাংশ শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে। অথচ তারা আমাদের শতভাগ ট্রেড ইউনিয়ন করার জন্য চাপ দিচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে তিনি দাবি করেন, প্রত্যেকেই যদি প্রত্যেকের জায়গা থেকে ঠিকঠাক দায়িত্বটা পালন করে যাই তাহলে কোনো প্রতিপক্ষ আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে বীরের জাতি। গর্বিত জাতি। প্রধানমন্ত্রীও কথা বলেন সাহসের সঙ্গে। বিশ্বের কোথাও যেহেতু এ অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের কার্যক্রম নেই, তাই বাংলাদেশেও নতুন করে তাদের মেয়াদ বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন হবে না। দেশের উদ্যোক্তারাও সেটা চায় না। আমরা কারও কাছে মাথা নত করব না।

পোশাক শিল্পে প্রণোদনা দেয়ার প্রয়োজন আছে জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ীদের দাবিগুলো যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু আমাদের সমস্যার কারণে এটা তাদের দিতে পারছি না। আমরা এগুলো সমাধান করার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সক্ষমতা বৃদ্ধির সূচক বর্তমানে ১০৬ থেকে নেমে ৯৯ এ আসছে। কিন্তু ব্যবসায়িক উন্নয়ন পরিবেশের সূচক ১৭৬-এ আছে। এটা ১০০-এর নিচে নামিয়ে আনার জন্য কাজ করছি।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বিজিএমইএ সহসভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাছির পোশাক খাতের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সেখানে ওঠে আসে এ খাত বর্তমানে কী কী সমস্যা মোকাবেলা করছে। একই সঙ্গে এর থেকে উত্তরণে কী কী করণীয় হতে পারে। ওই প্রবন্ধের অন্যতম বিষয়বস্তু ছিল বিদ্যুতের সমস্যা, অবকাঠামো সমস্যা, চট্টগ্রাম বন্দরের দুরাবস্থা এবং ঢাকা বিমানবন্দরের অচলাবস্থা। প্রবন্ধে তিনি পোশাক শিল্পের জন্য কর রেয়াত সুবিধাসহ প্রণোদনা দাবি করেন। এছাড়া ব্যাংক ঋণের জন্য আরও সহজ শর্ত চান।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর বিশ্বের অন্যতম ক্লিনেস্ট গার্মেন্টস শিল্প বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে। অথচ কিছু মানুষ রয়েছেন যারা বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে আমাদের দেশের বদনাম করে দেশকে ছোট করছেন। হয়তো তাদের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য। আমার জানা নেই এটা করে তারা কি পায়। আমার ধারণা, আমরা নিজেরা নিজেদের ইমেজ নষ্ট করছি। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক আছে সেটা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার কোনো প্রভাব পড়বে না। তাই রাশিয়ার বৃহত্তম বাজার ধরার সুযোগ অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা ডিউটি ফ্রি সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করব। তিনি বলেন, রফতানিকারকদেরও সংকীর্ণ মনোভাব রয়েছে। এ কারণে নতুন মার্কেটে ব্যবসা করার জন্য উদ্যোক্তা পাওয়া যায় না। আপনারা নতুন বাজার খুঁজুন। সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, আগামী ৩ বছরের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়া সম্ভব হবে। তবে এখনই বিদ্যুতের দামের একটা ফিক্সড রেট দেয়া সম্ভব নয়। কারণ এ খাতে সরকার এখনও ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। এটা ধীরে ধীরে করা হবে। গ্যাসের স্বল্পতা রয়েছে। এলএনজি আসছে। এটা এলে ঘাটতি দূর হবে। আগামী বছর এপ্রিল থেকে ওই গ্যাস দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু সেখানে বাড়তি মূল্য গুনতে হবে। সে জন্য ব্যবসায়ীদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তবে অর্থনীতি জোনের মধ্যে না থাকলে কাউকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ দেয়া হবে না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. তামিম বলেন, সরকারকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা বিদ্যুতে ক্যাপটিভ রাখবে নাকি শুধু গ্রিড থেকেই বিদ্যুৎ দিবে। এখানে সমস্যাও রয়েছে। ক্যাপটিভে ৪ টাকা খরচ পড়ে অথচ গ্রিডের মূল্য ৭ টাকা। এছাড়া আমাদের বিদ্যুতের দামের কোনো স্থিতিশীলতা নেই। তাই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একটা চুক্তিতে আসতে হবে। নির্দিষ্ট বছর পরপর বিদ্যুতের দাম কত শতাংশ বাড়বে তার একটি দিকনির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।

এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, আমরা নতুন নতুন বাজার খুঁজছি। সৌদি আরব, দুবাই, তুরস্কের সঙ্গে আমাদের নেগোসিয়েশন করা উচিত। আমরা যে কাজগুলো করছি এগুলো গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিদেশিদের কাছে তুলে ধরতে হবে। তিনি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দেয়ার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান।

ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, কি সংবাদ প্রচার করা যাবে আর কোনটা করা যাবে না এর কোনো নীতিমালা নেই। আজকের এ গোলটেবিল সরাসরি প্রচার করা হচ্ছে। এটা সরকারের ব্যর্থতা। রানা প্লাজার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। কিভাবে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতর সাংবাদিক প্রবেশ করল সে প্রশ্নও করেন তিনি। শ্যামল দত্তের মতে, পোশাক শিল্প মালিকদের সঙ্গে সাংবাদিকদের সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এটা দূর করতে হবে।

টেকসই উন্নয়ন অর্জনের (এসডিজি) মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা ব্যবসার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক জোন তৈরি হচ্ছে। সেখানে পোশাক শিল্প করতে চাইলে জমি দেয়া হবে। বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সেই জমিগুলো তৈরি হতে সময় লাগবে কিন্তু আমাদের এখনই জমি দরকার। তখন তিনি বলেন, আমাদের কাছে প্রতিনিধি পাঠান আমরা ৭ দিনের মধ্যে জমি দেব।

এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেন, বন্ডের কারণে প্রতি বছর ৬০ হাজার কোটি টাকা অপব্যবহার হচ্ছে। তিনি এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের কাছে সহযোগিতা চান। তখন সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমরা সহযোগিতা করব তবে কোথায় সমস্যা তা আপনাদের খুঁজে বের করতে হবে। আর যে ৬০ হাজার কোটি টাকার কথা বলা হচ্ছে সেটা পোশাক খাতের একার নয়। সব খাতের। কিন্তু দোষ চাপানো হয় পোশাক খাতের ওপর। এটা ঠিক নয়। তবে কেউ সুনির্দিষ্টভাবে দোষী হলে বিজিএমইএ তার সঙ্গে থাকবে না বলেও জানান তিনি।

পাওয়ার সেলের ডিজি মোহাম্মদ হোসেন বলেন, আমাদের বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিতরণও বাড়ছে। ফলে কিছু এলাকায় লোডশিডিং হচ্ছে। আমরা সমস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে যাচ্ছি।

সৌজন্যে : দৈনিক যুগান্তর