Logo

শ্রম আইনঃ শ্রমিকের সংজ্ঞায়ন, ‘মিড-লেভেল ম্যানেজার’র চাকরীর শর্তাবলী ও প্রসঙ্গকথা

RMG Times
শনিবার, আগস্ট ১৯, ২০১৭
  • শেয়ার করুন

ড. উত্তম কুমার দাস, এডভোকেট: দেশে আবার শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগ চলছে। প্রচলিত শ্রম আইন এবং বিধিতে বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা, আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ডের সঙ্গে সংঘর্ষ পূর্ণ নিয়ম-কানুন থাকার অভিযোগ, প্রয়োগে ব্যর্থতা প্রভৃতির প্রেক্ষাপটে সংশোধনের এই দাবী উঠে; এক্ষেত্রে দেশের শ্রমিক-আন্দোলনের প্রস্তাব, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)- এর শ্রম মানদণ্ডের প্রয়োগ-সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশসমূহ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দাবী ও চাপ প্রণিধানযোগ্য।

শ্রম আইন সংশোধনের প্রেক্ষাপটে যে যে বিষয় নিয়ে বেশী আলোচনা ও বিতর্ক হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে শ্রমিকের সংজ্ঞা এবং তাঁর সংগঠন (ট্রেড ইউনিয়ন) করার অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্টেশন করার শর্ত ও প্রক্রিয়া সহজীকরণ , ট্রেড ইউনিয়ন করার কারণে শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করা ও তার প্রতিকার প্রভৃতি  তবে লক্ষ্যনীয় হ’ল – এসব বিষয়ের উপর বেশী মনোযোগ থাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নজরের বাইরে থাকছে। (যা নিয়ে আলাদাভাবে লিখবো)।

শ্রম মানদণ্ডের প্রয়োগ-সংক্রান্ত কমিটি বছরের পর বছর তাদের সুপারিশে (যা পাবলিক ওয়েব-সাইটে পাওয়া যায়) শ্রম মানদণ্ডের আলোকে শ্রমিকের সংজ্ঞা বিস্তৃত করতে বলেছে।

বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ধারা ২(৬৫) তে উল্লেখিত “শ্রমিক”- এর সংজ্ঞা আরও বিস্তৃতিকরণ ও স্পষ্টীকরণ প্রয়োজন।

এখানকার শ্রমিক সংগঠনসমূহ, বিশেষতঃ ন্যাশনাল কো-অরডিনেশন কমিটি ফর ওয়ার্কারস এডুকেশন (NCCWE) – এর পক্ষ থেকে প্রস্তাব হ’ল- মালিকের সংজ্ঞায় পড়েনা অর্থাৎ কাউকে নিয়োগ ও চাকরীচ্যুতির ক্ষমতার অধিকারী ছাড়া যে কোন ব্যক্তি তা তার চাকরীর শর্তাবলী প্রকাশ্য বা উহ্য যেভাবেই থাকুক না কেন, যিনি কোন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠান বা শিল্প বা ঘর-বাড়ী-আঙ্গিনা বা পরিবহন বা কৃষিখাত বা ব্যক্তির অধীনে মজুরী বা অর্থের বিনিময়ে স্থায়ী, অস্থায়ী, সাময়িক, শিক্ষাধীন, শিক্ষানবীশ, মৌসুমি বা দৈনিক-ভিত্তিতে কাজ করার জন্য নিযুক্ত। 

এই প্রস্তাব কি ভাবে, কতটা গৃহীত হয় তা সামনের দিনগুলোতে বোঝা যাবে।

তবে শ্রমিকের সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের উচ্চ আদালতের প্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্তসমূহ বিবেচনায় নিতে হবে। এখন পর্যন্ত যে সব রায় এসেছে তাতে কে শ্রমিক, আর কে নয় তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির পদবী নয়, বরং তার কাজের প্রকৃতি (Nature of work) বিবেচ্য হবে বলে সিদ্ধান্ত এসেছে। এইক্ষেত্রে দেশের উচ্চ আদালত থেকে দেওয়া প্রাসঙ্গিক মামলার রেফারেন্স হ’ল 40 DLR (AD) (1988) 45 (50) (Para 7), 31 DLR 301, 19 BLC (2014) 472 (488) (Para 50)].

 আর শ্রমিকের সংজ্ঞা নিয়ে মনোযোগের কেন্দ্রে  রয়েছে তার সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। তবে এর একাধিক মাত্রা রয়েছেএর মধ্যে অন্যতম হল শিল্পসম্পর্ক তথা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার।

 আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হব্যক্তির চাকরীর শর্তাবলী (Conditions of employment) অর্থাৎ তার নিয়োগের শর্ত, বেতন ও সুযোগসুবিধা, ছুটি নির্ধারণ, অপসারণ (Termination) ও বরখাস্তসহ (Dismissal) চাকরীর অবসানের প্রক্রিয়া এবং প্রাসঙ্গিক প্রাপ্য ও সুবিধাদি প্রভৃতি বিষয় স্পষ্ট থাকা। কিন্তু সংজ্ঞা নির্ধারণের মারপ্যাঁচে যারা প্রথাগত শ্রমিকসংজ্ঞার বাইরে পড়েছেন বা পড়তে পারেন তাদের বিষয়ে মনোযোগের ঘাটতি রয়েছে।

বিশেষত প্রযুক্তি ও আইটি-নির্ভর শিল্পখাতের বিস্তারের সংগে সংগে শ্রমিক (Worker), কর্মী (Employee) এবং কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত অন্যদের সংজ্ঞা কি হবে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট-খাতের বিশেষজ্ঞ এবং শ্রম আন্দোলনের সংগে যুক্তদের সংগে ব্যাপক আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দরকার। তাদের কাজ শোভন হতে হলে তাতে চারটি শর্ত পূরণ প্রয়োজন- যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ, উপযুক্ত মজুরী, কর্মস্থলে সংগঠন করার স্বাধীনতা এবং সামাজিক সুরক্ষা।

আবার বুঝে বা না বুঝে যেভাবেই হোক বাংলাদেশ শ্রম বিধি, ২০১৫ প্রণয়নের মাধ্যমে আরও কিছু জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। বিধিতে “তদারকি কর্মকর্তা” এবং “প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি”- এর সংজ্ঞা গ্রহণ করা হয়েছে।

বিধি ২(ছ) অনুসারে “তদারকি কর্মকর্তা” অর্থ মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তপক্ষকত্রক লিখিতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত এমন কোন ব্যক্তি যিনি উক্ত ক্ষমতাবলে কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের কোন শাখার কোন কাজের বা সেবার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, কাজের পরিধি নিয়ন্ত্রণ, বাস্তবায়ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ, কাজের মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা, শ্রমিকদের দিক নির্দেশনা প্রদান বা তদারকি করেন।

বিধি ২(ঞ) বলেছে, “প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি” অর্থ মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তপক্ষ কত্রক লিখিতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি যিনি উক্ত ক্ষমতাবলে কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক বা কর্মচারীদের নিয়োগ, বেতন ও ভাতাদি নির্ধারণ, চাকরির অবসান বা চাকরি হতে অপসারণ, চূড়ান্ত পাওনাদি পরিশোধ এবং প্রতিষ্ঠানের ব্যয় অনুমোদন বা নিয়ন্ত্রণ কাজে নিয়োজিত।

উক্ত সংজ্ঞা দু’টি বিধিতে গ্রহণ করাতে একদিকে যেমন পারস্পরিক অসঙ্গতি ও সংঘর্ষ রয়েছে, অন্যদিকে প্রচলিত আইনের রীতি এবং এই বিষয়ে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে চলার প্রচলিত প্রথার ব্যত্যয় ঘটেছে।  মূল আইনে (শ্রম আইন ২০০৬) উপরোক্ত সংজ্ঞা দু’টি না থাকায় এবং বিধিতে তার অন্তর্ভুক্তি মূল আইনে “শ্রমিক”- এর চরিত্র আমুল বদলে দিয়েছে। তবে প্রশ্ন হ’ল বিধি প্রণয়নকালে তা করা যাবে কি-না।

শ্রম আইন, ২০০৬ এর ৩৫১(১) ধারা একদিকে সরকারকে যেমন “আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে” সমন্বিতভাবে একক অথবা পৃথক পৃথক বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়েছে, তেমনি ৩৫১(২) ধারা পরামর্শমূলকভাবে উল্লেখ করেছে, কোন কোন ক্ষেত্রে বিধি করা যাবে।

বিধি ২(ছ) “তদারকি কর্মকর্তা” বিধি ২(ঞ) “প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি”- এর যে সংজ্ঞা দিয়েছে তাতে মূল আইন প্রদত্ত ক্ষমতা-বহির্ভূতভাবে হয়েছে [Maula Bux v. Appellate Tribunal of State Transport Authority, Jaipur, AIR 1962 Raj 19] (উদ্ধৃতঃ মোঃ আখতারুজ্জামান, আইনের ব্যাখ্যা ও জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট, ঢাকাঃ রাজিয়া খাতুন, ২০১০, পৃষ্ঠা- ৩৫৯)। উপরোক্ত দু’সংজ্ঞা গ্রহণের মাধ্যমে কারখানা-প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিপুল সংখ্যক ব্যক্তিকে “শ্রমিক” সংজ্ঞার বাইরে নেওয়া হ’ল। যা উপরোক্ত মামলার রায়ের নিরিখে সঠিক হয়নি।

আর অসঙ্গতি হ’ল-  বিধির মাধ্যমে “তদারকি কর্মকর্তা” এবং “প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি”- তৈরি করা হ’ল কিন্তু তাঁদের  নিয়োগ, চাকরীর শর্ত, বেতন ও ভাতাদি নির্ধারণ, চাকরির অবসান বা চাকরি হতে অপসারণ, চূড়ান্ত পাওনাদি পরিশোধ প্রভৃতি কোন আইন বলে হবে তার কোন ইঙ্গিত বিধিতে রইল না। তাঁরা নিজেরাই যা যা তদারকি করবেন তাঁদের নিজেদের ক্ষেত্রেই তার শুন্যতা! এই আইনী শুন্যতা (Legal vacuum) সৃষ্টির বিষয়টি চ্যালেঞ্জযোগ্য- ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্থ যে কেউ তা করতে পারেন।

প্রচলিত আইন এবং বিধিতে শ্রমিকের পাশাপাশি কর্মচারীর (Employee)উপস্থিতি রয়েছে [শ্রম আইন ধারা ২(৬৫) এবং  বিধি ২(ঞ)]।  অথচ তাঁদের নিয়োগ, চাকরীর শর্ত, বেতন ও ভাতাদি নির্ধারণ, চাকরির অবসান বা চাকরি হতে অপসারণ, চূড়ান্ত পাওনাদি পরিশোধ- প্রভৃতি কোন আইন বলে হবে তার কোন সুরাহা আইন কিংবা বিধিতে নেই। এটি আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ড, মানবাধিকার ও আমাদের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের নীতিমালা এবং আমাদের প্রচলিত শ্রম আইনের বিধানের পরিপন্থী। এর তাৎক্ষনিক সমাধান হতে পারে শ্রম আইন, ২০০৬ এর ধারা দ্বিতীয় অধ্যায়ের ব্যাপ্তির প্রসার। ধারা ৩ এর প্রয়োজনীয় সংশোধন। যেমনঃ

৩। চাকরীর শর্তাবলী।– (১) প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক, কর্মচারী ও অন্যদের নিয়োগ ও তৎসংক্রান্ত আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়াদি এই অধ্যায়ের বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হইবেঃ …”

এখন দেশে, বিশেষতঃ কারখানা পর্যায়ে কথিত মধ্যম-পর্যায়ের ব্যাবস্থাপক (Mid-level Manager) নিয়োগ ও চাকরীচ্যুতির নামে যা চলছে সে বিষয়ে আমাদের নজর দেওয়া দরকার। এক্ষেত্রে দু’টি কেস-স্টাডি প্রনিধানযোগ্য (ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে)- 

(ক) ভদ্রলোক একটি স্বনামখ্যাত কারখানায় গত বছরের ১৫ মার্চ সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (কমপ্লায়েন্স) হিসেবে যোগদান করেন। অফিসে দেরি করে আসার “অপরাধে” চলতি বছরের এপ্রিল মাসে তাঁকে চাকরী থেকে “টার্মিনেট” করা হয়েছে। এইক্ষেত্রে দু’টি বিষয় উল্লেখ্যঃ তাঁকে দেরিতে আসার “অপরাধে” শাস্তি দেওয়া হলেও কোন নোটিশ কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ দেওয়া হয়নি। আর তিনি কোন ক্ষতিপূরণ পাবেন না, কারণ মালিকপক্ষ কথিত “চুক্তিপত্রের” বরাতে বলেছেন, তাতে উল্লেখ আছে, মালিকপক্ষের কাছে তাঁর “পারফর্মেন্স” গ্রহণীয় না হলে বিনা নোটিশে এবং কোন ক্ষতিপূরণ ছাড়া চাকরী থেকে বাদ দেওয়া যাবে। 

(খ) ভদ্রমহিলা আরেকটি স্বনামখ্যাত কারখানার জেনারেল ম্যানেজার (কোয়ালিটি)। তাঁর চাকরী দীর্ঘ ২২ বছর। তিনি ম্যানেজার পদে ১৯৯৫ সনে যোগ দেন। ইতিমধ্যে একই মালিকের তিনটি কারখানায় কাজ করেছেন, এবং চার-পাঁচবার পদোন্নতি পেয়েছেন। গত ১৩ জুন অফিসে গেলে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তিনি পদস্থদের সংগে যোগাযোগ করেও কোন ফল পাননি। অবাক ব্যাপার হ’ল ক’দিন পর তিনি এই মর্মে নোটিশ পেয়েছেন যে, তিনি বিনা অনুমতিতে ১০ দিনের বেশী অনুপস্থিত। তিনি চিন্তিত যে, তাঁর দীর্ঘদিন চাকরীর সুযোগ-সুবিধা পাবেন কি-না।

(এই দুই ঘটনারই আইনী প্রতিকার রয়েছে, তবে তা কি তা এখানে উল্লেখ করা হ’লনা)।

আমাদের দেশে সরকারের অধীনস্থ কোন অফিসের চাকরীজীবীদের জন্য প্রযোজ্য সরকারী চাকরী বিধিমালা; (তবে কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম তার জন্য শ্রম আইনের প্রথম অধ্যায় দেখুন)। বে-সরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত, কারখানা, প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতির ক্ষেত্রে শ্রম আইন প্রযোজ্য [শ্রম আইন, ২(৭), ২(৩১), ২(৪১)]।

শ্রম আইনের প্রধানতম দু’ই পক্ষঃ মালিক এবং শ্রমিক [ধারা ২(৪৯) এবং ২(৬৫)]। মালিক নিয়োগকারী (Employer) এবং শ্রমিক (এবং কর্মচারীসহ অন্যরা) নিযুক্ত (Employed)।

শ্রম আইনে নিয়োগের প্রক্রিয়া হ’ল নিয়োগপত্র (ধারা ৫)। অবসর গ্রহণকারী (শ্রমিক) কে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যাবে (ধারা ২৮)। শ্রম আইনের আর কোথাও চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের বিধান নেই। কোন প্রতিষ্ঠান তার নিজস্ব বিধিমালা করলেও তার বিধানে কোন শর্ত শ্রম আইনের চেয়ে কোনভাবে কম করা যাবে না (ধারা ৩)।

এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, কারখানা-প্রতিষ্ঠানে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের নামে আইন লঙ্ঘন চলছে। অধিকাংশ কথিত চুক্তিতে তার মেয়াদ (বিশেষত কবে শেষ হবে তা) চাকরী-অবসানের প্রক্রিয়াসহ (কোন চাকরী-সংক্রান্ত চুক্তির জন্য) আবশ্যিক উপাদানের উল্লেখ থাকেনা। কোন চুক্তিতে কি কি বিষয় থাকবে তা সংশ্লিষ্ট আইন দ্বারা নির্ধারিত। আর তা হতে হবে ন্যায্যতা ভিত্তিক(Fair); যাতে অবসানের ধরণ, তার পদ্ধতি, নোটিশ-সময়, আপীল করার পদ্ধতি এসবের বিধান থাকতে হবে।

চুক্তি আইন নিয়ে আমাদের এখানে ভুল ধারণা বিদ্যমান; তাই অপপ্রয়োগ হচ্ছে। কর্মসংস্থান সংক্রান্ত (Employment) চুক্তি আইনের সম-সাময়িক অবস্থান হ’লঃ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কোন স্বাভাবিক প্রবণতা হবে না; এটি হতে হবে বিশেষক্ষেত্রে- চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হবে কোন নির্দিষ্ট সময় এবং নির্দিষ্ট কাজের জন্য, নিয়মিত শ্রমিক বা কর্মী দিয়ে যা করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ স্থায়ী কোন পদের বিপরীতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বে-আইনী হবে। এই বিষয়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে। অথচ আমাদের এখানে কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ের বিভিন্ন এক্সিকিউটিভ, ম্যানেজার, জেনারেল ম্যানেজার প্রভৃতি পদে অহরহ কথিত চুক্তি-ভিত্তিক নিয়োগ চলছে।  কিন্তু তাদের দিয়ে যে ধরণের কাজ  করানো হচ্ছে তা স্থায়ী পদের জন্য প্রযোজ্য কাজ।

আর চুক্তি আইন পরিচালিত হয় কতগুলো নীতিমালার ভিত্তিতেঃ দেশের সাংবিধানিক বিধি-বিধান, নৈতিকতা, জন-নীতি (Public Policy), প্রচলিত প্রসঙ্গিক আইনের নীতিমালা (আমাদের ক্ষেত্রে শ্রম আইনের প্রাসঙ্গিক বিধান) প্রভৃতি।

কর্মসংস্থান সংক্রান্ত চুক্তি করার বিষয়ে আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য। ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট একাধিক রায়ে বলেছেন, যদিও অযাচিত প্রভাব বিস্তার অথবা বল প্রয়োগ দৃশ্যত অনুপস্থিত তবুও এমন কোন শর্ত কোন চুক্তিতে যদি পাওয়া যায় যা অন্যায্য (Unfair) বা বিবেক-বর্জিত(Unconscionable), অথবা কারও অর্থনৈতিক অসহায়ত্বের (Economic duress)সুযোগ নিয়ে তা করা হয়েছে তাহলে আদালত জন-নীতির নিরিখে এহেন চুক্তি বাতিল বলে ঘোষণা এবং তা সংশোধন করতে বলতে পারবেন (AIR 1986 SC 1571)।

আমাদের এখানে যেসব চাকরীর কথিত চুক্তিতে কাউকে অপসারণ (Termination) করার সময় কোন ক্ষতিপূরণ দিতে হবেনা- এমন শর্ত দেওয়া হয় তা উক্ত মামলার নিরিখে বে-আইনী। কারণ আমাদের শ্রম আইন কাউকে (কারখানা-প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শ্রমিক বা অন্য যে কেউ হোক) অপসারণকালে ১২০ দিনের নোটিশ বা ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছে।

ভারতের উচ্চ আদালতের সাম্প্রতিক কিছু রায়ে আরও কিছু বিষয় এসেছে; যেমন- কাউকে অপসারণ করা হলে উপযুক্ত কারণ ছাড়া তা করা যাবেনা। আর এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সময় দিয়ে নোটিশ বা তার বদলে ক্ষতিপূরণ, প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিরপ্রয়োগ (যা বিধিমালার মাধ্যমে করতে হবে), আপীলের সুযোগ, আয়-সুরক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা প্রভৃতির সুযোগ দিতে হবে। আদালত বিনা কারণে বা কোনো অপরাধে ছাড়া কারও কর্ম-হারানোকে জীবন ধারনের অধিকার থেকে(Right to life) বঞ্ছিত করার সংগে তুলনা করছেন।   

ভারতের উদাহরণ টানার কারণ হ’ল যে সব ক্ষেত্রে আমাদের আইন অস্পষ্ট সেসব ক্ষেত্রে ওইখানকার উচ্চ আদালতের প্রাসঙ্গিক রায় আমাদের জন্য পরামর্শমূলক হবে।  

আমাদের এখানে মধ্যম-পর্যায়ের ব্যাবস্থাপকসহ অন্যদের কথিত চুক্তির মাধ্যমে নিয়োগ করে দেশের সংবিধান প্রদত্ত ব্যক্তির পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ৪০), আইনী-সুরক্ষা পাওয়া (৩১), জীবন ও ব্যাক্তি-স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ (৩২) প্রভৃতি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে- এটি বলা যায়। এতে করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার সামাজিক সুরক্ষা, কর্মে নিয়োজিত হওয়ার অধিকার, স্বাধীনভাবে কাজ পছন্দ করা এবং বেকারত্ব থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার প্রভৃতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন (সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২২ ও ২৩ অনুচ্ছেদ)। আমাদের দেশের উচ্চ আদালতের একাধিক রায়েও এসব অধিকার সুপ্রতিষ্ঠা পেয়েছে। মানবাধিকার ও আইনের এহেন লঙ্ঘন বন্ধে রাষ্ট্র তথা তার সংশ্লিষ্ট প্রশাসনযন্ত্রের আশু উদ্যোগ ও তৎপরতা দরকার। 

আমি উপরের বিষয়গুলো উল্লেখ করে ইতিমধ্যেবাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ সংশোধনের সম্ভাবতা নির্ধারণ সংক্রান্ত ত্রি-পক্ষীয় কারিগরি কমিটির আহ্বায়ক বরাবরে আমার মতামত ও প্রস্তাবনা পেশ করেছি। সংশোধন প্রস্তাবনা তৈরি করার সময় বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় তা বিবেচনায় নেওয়ার জন্য কারিগরি কমিটির সদয় দৃষ্টি আকর্ষণওকরা হয়েছে। একই পত্রের অনুলিপি শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী,শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং কল কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক প্রমুখকে দেওয়া হয়েছে।

(প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব- একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এবং মানবাধিকার ও শ্রম আইন বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী হিসেবে। এর সংগে তার প্রাতিষ্ঠানিক সংশ্লিষ্টতার কোন সম্পর্ক নেই।)

লেখক : এডভোকেট, সুপ্রীম কোর্ট অব বাংলাদেশ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা থেকে মানবাধিকার আইনে স্নাতকোত্তর  (এলএল. এম.) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

ফোনঃ০১৭৫৬ ৮৬৬৮১০, ই-মেইলঃ [email protected]