Logo

বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্র ও শিল্প মালিকগণের দায়বদ্ধতা

RMG Times
শনিবার, আগস্ট ১৯, ২০১৭
  • শেয়ার করুন

আখলাকুর রহমান : পোশাক রপ্তানি যদি কোন কারণে একমাসের জন্য থেমে যায় তবে দেশের অর্থনীতি এক পলকে ভেঙে গিয়ে দেশ থমকে যাবে। রপ্তানিমূখী পোশাক শিল্পে ৫০ লক্ষ শ্রমিক (বাংলাদেশে সরকারী চাকুরীজীবিদের সংখ্যা ২১ লক্ষ) কাজ করছেন এবং এর ৮০% নারী। পরোক্ষ ভাবে এই শিল্পের সাথে আরো ৫০ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান জড়িত। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০% আসে পোশাক রপ্তানি থেকে। ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে $25.49 billion (1 billion=1000 million, 1 million=$1000000, 1 million=৮কোটি টাকা, $1=৮০ টাকা হিসাবে)। ২০২১ সালে পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ বিলিয়ন ডলার। যা বর্তমান পোশাক রপ্তানির চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। IMF(International Monetary Fund) এর মতে বাংলাদেশ ২০১৬ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৃদ্ধিশীল অর্থনীতির দেশ। যদি প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশ ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলার পোশাক রপ্তানির লক্ষমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয় তবে সহজেই অনুমেয় দেশের অর্থনীতি কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছুবে। কিন্তু ক্রেতাদের কর্তৃক পোশাকের মূল্য কয়েক দফা কমানো, দেশে শিল্পখাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের অপ্রতুলতা, যানজট এবং বন্দরে আমদানী ও রপ্তানিতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হওয়া, দুর্নীতি, সংযোগ শিল্পে পিছিয়ে থাকা সহ বিভিন্ন কারণে রপ্তানি লক্ষ্য মাত্রা অর্জিত হবে কি-না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহল সংশয় প্রকাশ করেছেন ইতিমধ্যে।

উদ্যোক্তা, অর্থ, জমি, অবকাঠামো ও মেশিনপত্র একটি রপ্তানিযোগ্য পোশাক শিল্পের অন্যতম প্রধান প্রধান উপাদান এবং এই শিল্প শ্রমঘন হওয়ার কারণে, শ্রমিক বা কর্মী হলো এর অন্যতম আরো একটি মৌলিক উপাদান। বিশাল এই কর্মীবাহিনীকে বাদ দিয়ে এই শিল্পের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। পিছিয়ে পড়া, পশ্চাৎপদ, অনুন্নত গ্রামাঞ্চল থেকে আসা অর্থনীতির মৌলিক মেরুদন্ড বা চালিকা শক্তি নারীরা রপ্তানী আয়ের ৮০% বিদেশী মুদ্রা অর্জনকারী। যাদের ওপর ভর করে দেশ চলছে অথচ তাদের কথা সমাজ, রাষ্ট্র এবং কারখানা মালিকগণ গভীর ভাবে চিন্তা করছেন না। যে শ্রেণীর ওপর নির্ভর করে ২০২১ সালে দেশ ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি লক্ষ্য মাত্রার স্বপ্ন দেখছেন, তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্যগত এবং ভবিষ্যত নিরাপত্তার কথা ভাবনার কোন প্রয়াস তাঁদের মধ্যে লক্ষণীয় নয়। শিল্পের মালিকগণ এবং পোশাক রপ্তানিকারক সংগঠন (BGMEA ও BKMEA) তাঁরা তাঁদের শ্রমিকদের নিয়ে তেমন কিছু ভাবছেন না। আর সরকার তো নয়-ই। যদি ৫০বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষমাত্রা অর্জিত হয়, তবে দেশে একটি অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধিত হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এর ফলে দেশের অন্যান্য সকল খাতে প্রভূত অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জিত হবে এবং বাংলাদেশও এক অলিখিত অর্থনৈতিক মূকুট অর্জন করবে সারা বিশ্বে।তাই পোশাক শিল্পের এই মৌলিক ভিত্তিকে কর্মক্ষম রাখা, সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা অর্জনের জন্য তৈরী করা, নুতুন ভাবে আগত অদক্ষ কর্মীদের, দক্ষকর্মী হিসেবে তৈরী করা, তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, ভবিষ্যত নিরাপত্তার বিধান করার কর্তব্য হলো সমাজ, রাষ্ট্র এবং শিল্পমালিকদের।

মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি, বিদ্যুত ও গ্যাসের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি, কোন যৌক্তিক কারণ ব্যতিত বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি সহ নানা কারণে পোশাক কর্মীদের জীবন ধারণ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে। সরকার, শিল্প মালিকদের নানা প্রকার আর্থিক ও আনুতোষিক প্রণোদনা দিয়ে আসছেন শিল্পের প্রসার ও রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য। বিন্তু এ সকল শিল্পের কর্মে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য কোন প্রকার প্রণোদনা নেই কেন? আর প্রণোদনা না থাকার বিষয়টি অত্যন্ত দু:খজনক। আধুনিক সভ্য সমাজে এই ধরণের বৈষম্য কোন ভাবেই কাম্য নয়, নয় সহনীয়। দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি আরো শক্ত মজবুত করার জন্য সরকার, শিল্পের মালিকগণ সহ্য অন্যান্য অংশীদারদের এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে শ্রমিকদের বাঁচানোর জন্য। মনে রাখা উচিত পোশাক শিল্প সম্পূর্ণ শ্রম নির্ভর শিল্প তাই এর কর্মীদের জীবন সংগ্রামে টিকিয়ে রাখতে না পারলে প্রকৃতপক্ষে দেশেরই ক্ষতি হবে। যে ক্ষতি কখনও পুরণ করা সম্ভব হবেনা। তাই পোশাক শ্রমিকদের সার্বিক জীবন মানের উন্নয়ন ও ভবিষ্যত নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু প্রস্তাবনার অবতারনা করছি। এই প্রস্তাবনাগুলো মূল্যায়ন করা হলে, ঠেকসই উৎপাদন ব্যবস্থাপনা এবং পোশাক শিল্প একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে এবং অর্থনৈতিক বিপ্লব পরিপূর্ণতা পেয়ে দেশ ও জাতি, উন্নত দেশ ও জাতিতে পরিণত হবে নিকট ভবিষ্যতে।

ক) শ্রমিক/কর্মীদের একটি ইউনিক আইডি কার্ড বানানো, যা তার জাতীয় পরিচয়পত্রের সাথে সমন্বয়ে করা হবে এবং সরকার ও বিজিএমইএ/বিকেএমইএ-র সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজে সংরক্ষিত থাকবে। যে ডাটাবেজের মাধ্যমে একটি কেন্দ্রীয় ভাবে নিয়ন্ত্রিত, জীবন ও স্বাস্থ্য বীমার সূত্রপাত করা হবে।

খ) সরকার, বিজিএমইএ/বিকেএমইএ এবং অন্যান্য অংশীদারীদের সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রীয় ভাবে নিয়ন্ত্রিত ভবিষ্যত তহবিল তৈরী করা প্রয়োজন। যেখানে সরকারী এবং বেসরকারী ব্যাংকে নির্দিষ্ট সংখ্যক কর্মীর ভবিষ্যত তহবিল একাউন্ট খোলা হবে। নুতুন শ্রমিক পোশাক খাতে প্রবেশ করার ৬ মাস পর তার নামে একটি ভবিষ্যত তহবিল খোলা হবে এবং কর্মী ও কারখানা কর্তৃপক্ষ উভয় পক্ষের চাঁদা প্রতি মাসের নির্দিষ্ট তারিখে জমা করবেন। শ্রমিক/কর্মীদের চাকুরী পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নুতুন কারখানায় যোগদানের ৬মাস পর থেকে নুতুন কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যত তহবিলের টাকা ঐ শ্রমিকের পূর্বের তহবিল একাউন্টেই জমা রাখবেন এবং মধ্যের ৬মাস শ্রমিক উভয় অংশের টাকা জমা করবেন। ভবিষ্যত তহবিল আইনানুসারে তা চলতে থাকবে এবং আইন মোতাবেক কর্মীরা তাদের ভবিষ্যত তহবিলের অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন।

গ) বাংলাদেশ শ্রম আইনের সার্ভিস বেনেফিট বা গ্রাচুইটি বিষয়ে জটিলতা না রেখে সহজ ভাবে প্রতি এক বছর চাকুরী পূর্ণ করার পর কোন শ্রমিক/কর্মীর চাকুরী অবসান, পদত্যাগ বা যে ভাবেই চাকুরীচ্যুত হোক না কেন তাকে প্রতি ১বছরের জন্য এক মাসের বেসিক বেতন দেওয়ার জন্য আইনের ধারাটি সংশোধন করে প্রস্তাবনা অনুসারে তা বাস্তবায়ন করা জরুরী।

ঘ) পোশাক শ্রমিক/কর্মীরা ৩০% হারে বিদ্যুত ও গ্যাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে নগদ রেয়াত পেতে পারেন।

ঙ) সরকার, কারখানার মালিকগণ এবং অন্যান্য অংশীদারীদের মাধ্যমে পোশাক শ্রমিক/কর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকাগুলোতে গ্রহণ যোগ্য ভাড়ায় বসবাসের জন্য বাড়ি তৈরী করে দেওয়া তাঁদের নৈতিক দায়িত্বই। এবং তাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় স্কুল এবং হাসপাতাল নির্মাণ করা একান্ত প্রয়োজন। তাছাড়াও শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন, মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ আরো বৃদ্ধি করা সময়ের দাবি।

চ) প্রথাগত জীবন বীমা পদ্ধতি বাতিল করে, কেন্দ্রীয় ভাবে জীবন ও স্বাস্থ্য বীমার জন্য স্থায়ী বিমা পদ্ধতি চালু করা যায়। এর ফলে শ্রমিক/কর্মীর চাকুরী অবসান বা পদত্যাগের কারণে যাতে তার বীমার কোন অবসান না হয়। তারা ইচ্ছে করলে যাতে নিজেরাই বীমার কিস্তি দিয়ে বীমা চালু রাখতে পারেন।

একটি ইমার্জিং অর্থনীতির দেশের অর্থনৈতিক মৌলিক চাকাকে গতিময় রাখা এবং বিশ্বে একটি শক্ত স্থায়ী অর্থনীতির দেশ হিসাবে দাঁড়ানোর এবং ঠিকে থাকার জন্যে উপরোক্ত প্রস্তাবনাগুলো পোশাক শিল্পের শ্রমিক/কর্মীদের কল্যাণে বাস্তবায়নআদৌ বেশী কিছু নয়। সরকার, কারখানার মালিকগণ এবং অন্যান্য অংশীদারদের স্বদিচ্ছা থাকলে এই বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন কঠিন কোন কাজ নয়।

লেখক: পরিবেশবিদ