Logo

পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার রহস্য কি?

RMG Times
সোমবার, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৮
  • শেয়ার করুন

মোঃ খাইরুল ইসলামঃ গত নভেম্বর মাসে প্রকাশিত দেশের পোশাক কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে শ্রকিদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে যা কারখানার মালিক পক্ষকে অত্যন্ত ভাবিয়ে তুলেছে। বিভিন্ন জোনে শ্রমিকদের অসন্তোষ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রকাশিত ন্যূনতম মজুরি গেজেটে সর্বনিম্ন মজুরি করা হয়েছে ৮ হাজার টাকা। এটি সপ্তম গ্রেডে যেসব শ্রমিক কাজ করছেন বা করবেন তাদের জন্য এই বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যান্য গ্রেডে যারা কাজ করছেন তাদেরও সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারিত হয়েছে। সপ্তম গ্রেডের পরের ধাপ থেকেই শুরু হয়েছে সেলাই মেশিন অপারেটরদের গ্রেড, তথা গ্রেড ৬। গেজেট পর্যবেক্ষণে দেখা যায় এতে যারা কাজ করবেন বা করছেন তারা পাবেন প্রতি মাসে ৮৪০৫ টাকা। ষষ্ঠ থেকে তৃতীয় গ্রেড পর্যন্ত সেলাই মেশিন অপারেটর রয়েছে। মূলতঃ এই চার গ্রেডে শ্রমিকের সংখ্যা বেশী এবং তাদের মধ্যেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

শ্রমিকদের প্রশ্ন- এখনো কেন আমাদের বেতন কত বেড়েছে তা জানানো হয়না? একজন সহকারী বা হেলপারের বেতন যদি ৮ হাজার টাকা হয় তাহলে আমাদের কত হবে? হেল্পারের বেতন যদি এত হয় আমাদের বেতন নিশ্চিত আরো অনেক বেশী হবে? পাশাপাশি বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি কি হবে? সরাসরি সমন্বয় হবে না বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি করে গেজেট নির্ধারিত মজুরি সমন্বয় হবে?

এসব প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের হতে হয়েছে। এসব প্রশ্ন থেকেই নানান কারখানায় শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দিয়ে বসে আছে, কখনো রাস্তা অবরোধ করছে, নানান জায়গায় নানান ভাবে কারখানা কর্তৃপক্ষ হয়রানী হচ্ছেন। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, শিপমেন্টেরও ক্ষতি হচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

এখন আসি শ্রমিকদের উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তর প্রসঙ্গে।এ প্রশ্নের উত্তর কি যেসব কারখানায় অসন্তোষ হচ্ছে সেসব কারখানার কর্তৃপক্ষ বা মানবসম্পদ ও কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তাদের নিকট নেই? নাকি তারা শ্রমিকদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে সমস্যা সমাধান করতে পারছেন না?

যদি ২০১৩ সাল ও ২০১৮ সালের ন্যুনতম মজুরি গেজেট পর্যবেক্ষণ করি তাহলে গ্রেড ভিত্তিক যে পরিমান বেতন বৃদ্ধি হয়েছে তাহলো, ১ নং গ্রেড ৪৫১০ টাকা, ২নং গ্রেড ৩৭৩০ টাকা, ৩নং গ্রেড ২৭৮৫ টাকা, ৪নং গ্রেড ২৮২৫ টাকা, ৫নং গ্রেড ২৮১৩ টাকা, ৬নং গ্রেড ২৭২৭ টাকা, ৭নং গ্রেড ২৭০০ টাকা ও ট্রেইনী ১৭৯৫ টাকা। এই বৃদ্ধি ২০১৩ সালের গেজেট থেকে ২০১৮ সালের গেজেট হিসেবে।

উপরোক্ত চার্ট অনুযায়ী ২০১৩ সালের যে সর্বনিম্ন মজুরি ছিল এবং ২০১৮ সালের ১লা ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া সর্বনিম্ন মজুরির পার্থক্য বা বৃদ্ধি।

২০১৩ সালের সর্বনিম্ন মজুরির তালিকাঃ ২০১৩ সালের গেজেট অনুযায়ী ১ নং গ্রেড ১৩০০০ টাকা, ২নং গ্রেড ১০৯০০ টাকা, ৩নং গ্রেড ৬৮০৫ টাকা, ৪নং গ্রেড ৬৪২০ টাকা, ৫নং গ্রেড ৬০৪২ টাকা, ৬নং গ্রেড ৫৬৭৮ টাকা, ৭নং গ্রেড ৫৩০০ টাকা ও ট্রেইনী ৪১৮০ টাকা বেতন নির্ধারিত ছিল।

২০১৮ সালের সর্বনিম্ন মজুরির তালিকাঃ আর বর্তমানে ২০১৮ সালে এসে সর্বনিম্ন মজুরি দাঁড়িয়েছে ১ নং গ্রেড ১৭৫১০ টাকা, ২নং গ্রেড ১৪৬৩০ টাকা, ৩নং গ্রেড ৯৫৯০ টাকা, ৪নং গ্রেড ৯২৪৫ টাকা, ৫নং গ্রেড ৮৮৫৫ টাকা, ৬নং গ্রেড ৮৪০৫ টাকা, ৭নং গ্রেড ৮০০০ টাকা ও ট্রেইনী ৫৯৭৫ টাকা।

২০১৩ সালের সর্বনিম্ন মজুরি থেকে ২০১৮ সালে গ্রেড অনুযায়ী শতকরা বৃদ্ধির হারঃ ১ নং গ্রেড ৩৪.৬৯%, ২নং গ্রেড ৩৪.২২%, ৩নং গ্রেড ৪০.৯৩% টাকা, ৪নং গ্রেড ৪৪%, ৫নং গ্রেড ৪৬.৫৬%, ৬নং গ্রেড ৪৮.০৩%, ৭নং গ্রেড ৫০.৯৪% ও ট্রেইনী ৪২.৯৪% হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

উভয় গেজেটের মধ্যবর্তী প্রায় ৫ বছর অতিবাহিত হয়েছে। যারা একই কারখানায় কর্মরত ছিল বা আছে তারা অন্তত ৫% হারে প্রতিবছর বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে। আর যারা কারখানা বদল করেছে তারা আলোচনা সাপেক্ষে দক্ষতা অনুযায়ী বেতনে কাজে যোগদান করেছে।

বর্তমান ন্যুনতম মজুরি ঘোষণার প্রেক্ষিতে শ্রমিকদের মনে উত্থাপিত কতিপয় প্রশ্নের উত্তর তাহলে কি হবে? উক্ত হিসেব নিকেশ তো আর সাধারণ শ্রমিকরা বুঝবে না। তাদের ধারণা একজন হেলপারের বেতন যেহেতু ৮ হাজার টাকা, তাহলে তাদের বেতন আরো বেশী হবে। আসলে বেশীই হয়েছে কিন্ত ২০১৩ সালের গেজেট অনুযায়ী হেলপারের বেতন দিনে দিনে বাড়লেও কারখানায় স্থিতাবস্থা না থাকায় ৫৩০০ টাকার কাছাকাছি রয়ে গেছে। তার আরেকটি কারণ হলো সপ্তম গ্রেডে একজন শ্রমিক বেশী দিন থাকেনা। হয় সে অপারেটর হয় নয় অন্য কোন পদে পদোন্নতি পেয়ে যায়।

এদিকে অপারেটরদের বেতন প্রতিবছর ৫% বৃদ্ধি পেয়ে কারো কারো বেতন বর্তমান সর্বনিম্ন মজুরি সমপরিমাণ হয়ে আছে কোন কোন কারখানায়। যেমন, বিভিন্ন কারখানা নতুন অপারেটরদের নিয়োগের সময় দক্ষতা অনুযায়ী ৮ হাজার টাকারও উপরে বেতন নির্ধারণ করেন। তার কারণ হলো অপারেটরের ঘাটতি পূরণ ও ধরে রাখার জন্য এটা করা হয়ে থাকে। মোদ্দাকথা হলো ডিসেম্বরের আগেই অনেক কারখানার শ্রমিকের বেতন ৮ হাজার টাকার চেয়ে বেশী আছে। এখানে যেসব শ্রমিকের বেতন বেশী আছে তারা মনে করছে তাদের বেতন তো বেশী বাড়বে না। আবার যাদের নিয়োগ দু-চার মাস আগে হয়েছে, তারাও ভাবছে তাদের বেতন কত বাড়বে? আবার অনেক কারখানায় বেতন বেশী করে ধরলেও গ্রেড বা পদ ধরে রাখার পলিসি নিয়ে নিয়োগ করে। ফলে যখন গ্রেড নিয়ে আলোচনা তুমুল, তখন শ্রমিকরা গ্রেড সচেতন হতে চেষ্টা করে ও তাদের কৌতুহল বেড়ে যাওয়ায় আজকে দেশের বিভিন্ন কারখানায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

এই প্রেক্ষিতে কি করনীয় তা নির্ধারণ করতে কারখানাগুলো হিমশিম খাচ্ছে, আবার বেতন বৃদ্ধির ধাক্কা সামলাতে নানান দিকে খরচ নিয়ন্ত্রণ করে কারখানা বাঁচানোর জন্য কাজ করছে। তথাপি শ্রমিকরা ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে অথবা উস্কানী পেয়ে শ্রমিকরা কারখানায় কাজ বন্ধ রাখছে। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, কারখানা অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সর্বোপরি বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

১লা ডিসেম্বর ২০১৮ইং তারিখ থেকে সর্বনিম্ন মজুরি কার্যকর হচ্ছে তাতে কোন শ্রমিকের বর্তমান বেতন এবং বেসিক কমবে না। বরং যার যে বেসিক বেতন রয়েছে তা ঠিক রেখে বা গ্রেড ভেদে বেতন ঠিক করে পূনঃনির্ধারণ হবে। প্রতিবছর ৫% হারে আগের মত বেতন বৃদ্ধি পাবে। ফলে শ্রমিকদের এই বিষয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হওয়ার কিছু নেই। কারখানা কর্তৃপক্ষ গেজেট অনুযায়ী সর্বনিম্ন মজুীর প্রদান করতে অবশ্যই সম্মত।

লেখক- মোঃ খাইরুল ইসলাম, সহকারী ব্যবস্থাপক(মানবসম্পদ ও পেরোল)

জায়ান্ট গ্রুপ।