Logo

শ্রম আইনে নারী শ্রমিকের সুরক্ষা

RMG Times
শনিবার, মে ১৫, ২০২১
  • শেয়ার করুন

ড. উত্তম কুমার দাস, এডভোকেট:

ভূমিকা:
বাংলাদেশে বে-সরকারী পর্যায়ের চাকুরীর শর্তাবলী নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য প্রযোজ্য হ’ল বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬। যা সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান ও কারখানার জন্য প্রযোজ্য। কোন প্রতিষ্ঠান বা কারখানা তার নিজস্ব চাকুরী বিধিমালা বা সার্ভিস রুলস তৈরি করতে পারবে, তবে তার মানদণ্ডের ভিত্তি হতে হবে শ্রম আইনের সংশ্লিষ্ট বিধান (শ্রম আইন, ৩ ধারা)।

এছাড়া দেশের রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) জন্য পৃথক আইন রয়েছে। যার নাম হ’ল বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন, ২০১৯; তাদের আগের আইনকে রদ করে এটি করা হয়েছে। এই আইন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্যও প্রয়োগ করা হয়।

শ্রম আইনের কাঠামো:
বাংলাদেশ শ্রম আইন যে উদ্দেশ্যে প্রণীত তা উক্ত আইনের প্রারম্ভে (Preamble) বলা হয়েছে; যথা- (ক) শ্রমিক নিয়োগ, (খ) মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক, (গ) সর্বনিম্ন মজুরী হার নির্ধারণ, (ঘ) মজুরী পরিশোধ, (ঙ) কার্যকালে দুর্ঘটনাজনিত কারণে শ্রমিকের জখমের জন্য ক্ষতিপূরণ, (চ) ট্রেড ইউনিয়ন, শিল্প-বিরোধ ও তার নিষ্পত্তি, (ছ) শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও চাকুরীর অবস্থা ও পরিবেশ, এবং (জ) শিক্ষাধীনতা।

শ্রম আইনের কাঠামোগত দুর্বলতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল দেশে এর সার্বজনীন প্রয়োগ নেই। আগেই বলা হয়েছে সারা দেশের জন্য এক শ্রম আইন; আর রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ এলাকার জন্য আরেক শ্রম আইন বিদ্যমান, যাতেও রয়েছে নানান সীমাবদ্ধতা-অসঙ্গতি।

বাংলাদেশ শ্রম আইন (২০০৬) পূর্বেকার সংশ্লিষ্ট ২৫ টি আইনের এক সংকলন। তবে এই কাজে যথাযথ সমন্বয় হয়নি; তাই কোন বিষয় নিয়ে বিভিন্ন অধ্যায়ে সংঘর্ষ-পারস্পরিক বিরোধিতা রয়েছে; যেমন- মজুরীর সংজ্ঞা, প্রসূতিকল্যাণ ছুটি ও সুবিধা, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদি।

শ্রম আইন শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক খাত এবং সেইখাত-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান-কারখানার জন্য প্রযোজ্য হয়। যার আওতায় মোট শ্রম-গোষ্ঠীর (দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী প্রায় সাড়ে ছয় কোটি) মাত্র শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ শ্রম আইনের আওতায়। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমজীবী মানুষ, গৃহ-পরিচারক এবং কৃষি খামারে নিয়োজিতরা (যেখানে সাধারণতঃ পাঁচ জনের কম শ্রমিক কাজ করেন) শ্রম আইনের আওতার বাইরে। এছাড়া “মুনাফা বা লাভের জন্য পরিচালিত নহে এমন শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা গবেষণার” নামে আরেক ধরণের প্রতিষ্ঠানকে উক্ত আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে; যার অপব্যবহারও হচ্ছে। “সামাজিক উদ্যোগ” কিংবা “ট্রাস্ট” পরিচয়ের আড়ালে অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান শ্রম আইনের আওতা এড়ানোর প্রচেষ্টা বা অপচেষ্টা করছে; যার প্রধানতমঃ উদ্দেশ্য হ’ল সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারীদেরকে শ্রম আইন নির্ধারিত সুরক্ষা ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা।

আইনে নারী-সম্পর্কিত বিধান:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিতে বলে হয়েছে, “রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিককে- এবং জনগনের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষন হইতে মুক্তি দান” (অনুচ্ছেদ- ১৪)। আরও বলা হয়েছে- “কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরীর বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার;” [অনুচ্ছেদ- ১৫(খ)]।

মহান সংবিধানে আরও উল্লেখ রয়েছে- “সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন;” [অনুচ্ছেদ- ১৯(১)]।

শ্রমের অধিকার সম্পর্কে সংবিধানে সুস্পষ্ট কিছু বিধান রয়েছেঃ “কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়, এবং “প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী”- এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।” [অনুচ্চেদ- ২০(১)]।

অনেকে বলতে পারেন, উপরোক্ত বিধান রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিতে বলা হয়েছে; মৌলিক অধিকার হিসাবে নিশ্চয়তার মধ্যে নেই। তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, মাননীয় বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এবং অন্যান্য দেশের উচ্চ আদালত থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট নীতি ও আইনকানুন প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নে উপরের বিষয়গুলোকে (রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিসমূহ) গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিতে হবে, ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।

সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “(১) সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।
(২) সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।”

এবার সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার প্রসঙ্গে আসা যাক।

সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছদের বিধান হ’ল- সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ২৮ অনুচ্ছেদের বিধান হ’ল- কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিগের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য দেখাবে না। রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন।

জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা, ২০১১-এর উদ্দেশ্য হ’ল- সংবিধান প্রদত্ত বিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও গণজীবনের সকল ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্র, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে বলে উক্ত নীতিমালায় বলা হয়েছে।

জাতীয় শ্রম নীতিমালা, ২০১২-এর লক্ষ্য হিসাবে বলা হয়েছেঃ “বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে সকল কর্মক্ষম নাগরিকের জন্য উৎপাদনমুখী, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, শোভন, নিরাপদ স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সকল ক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার ও শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা।” এর অন্যান্য উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে, কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণ।

এছাড়া আরও বলা হয়েছে যে “… নারীর নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত এবং নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি ও মাতৃত্ব সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে সরকার আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে পারবে।” (দফা- ১৯)।

উপরোক্ত সংবিধানের বিধানাবলী, নারী উন্নয়ন নীতিমালা কিংবা জাতীয় শ্রম নীতিমালার বিবরণের আলোকে যদি শ্রম আইনকে দেখা হয় তবে এক কথায় বলা যায় যে বিদ্যমান শ্রম আইনে ওইসবের কোন (পূর্ণাঙ্গ) প্রতিফলন নেই। এতে দরকার অধিকতর সংশোধন-সংযোজন।

নারী শ্রমিক সম্পর্কে শ্রম আইনে কি আছে?
বিদ্যমান শ্রম আইনের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ অংশ বা বিধান, যেমন- ভূমিকা, সংজ্ঞা, নিয়োগ ও চাকুরীর শর্তাবলী (যেমন- বিশ্রাম ও স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা), কর্মস্থলে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা প্রভৃতিকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে লিঙ্গ-সমতাভিত্তিক (জেন্ডার-ভিত্তিক) নিয়োগ, নারী শ্রমিকের প্রতি বৈষম্য প্রতিরোধ ও বিলোপ এবং যৌন হয়রানীর প্রতিরোধ ও প্রতিকার- এসকল বিষয় নিয়ে উল্লেখ করার মতো কোন বিধান নেই শ্রম আইনে।

শ্রম আইনে “মহিলা শ্রমিক” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে [যেমন- ২(৩৪), ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫৯, ৭৯, ৮৭, ১০৯, ৩৩২, ৩৪৫ ধারা প্রভৃতি); যা নারীর প্রতি অবমাননা বলে আমরা মনে করি। সংবিধান কিংবা বিভিন্ন (উপরোক্ত) নীতিমালায় “নারী” শব্দ ব্যবহার করা হলেও শ্রম আইনে “মহিলা” শব্দ ব্যবহার অনাকাঙ্ক্ষিত।

আইনের ৩৩২ ধারায় বলা হয়েছে, “কোন প্রতিষ্ঠানের কোন কাজে কোন মহিলা নিযুক্ত থাকিলে, তিনি যে পদমর্যাদারই হোন না কেন, তার প্রতি উক্ত প্রতিষ্ঠানের অন্য কেহ এমন কোন আচরণ করিতে পারিবেন না যাহা অশ্লীল কিংবা অভদ্রজনোচিত বলিয়া গণ্য হইতে পারে, কিংবা যা উক্ত মহিলার শালীনতা ও সম্ভ্রমের পরিপন্থী।”

কিন্তু অবাক করার বিষয় হ’ল আইন কিংবা পরবর্তীতে শ্রম বিধিমালায় উক্ত “অশ্লীল কিংবা অভদ্রজনোচিত” আচরণ কিংবা “শালীনতা” বা “সম্ভ্রম”-এর কোন সংজ্ঞা কিংবা উপাদান উল্লেখ করা হয়নি। ফলে উক্ত বিধান মূলতঃ কোন সুফল বয়ে আনেনি।

আরেকটি মৌলিক বিষয়, শ্রম আইন মূলতঃ শ্রমিক বা মালিকের জন্য, যাদের সংজ্ঞা আইনের ২(৬৫) ও ২(৪৯) ধারায়। তাই ৩৩২ ধারায় “কোন মহিলা” বলতে কি বোঝানো হয়েছে তা স্পষ্ট নয়- তিনি কি নারী সুপারভাইজার? নারী ম্যানেজার? না-কি মালিক, যিনি একজন নারী?

দুঃখজনক হ’ল কোন নারী সুপারভাইজার কিংবা ম্যানেজার শ্রম আইনের আওতায় সুরক্ষা পাবেন না। কারণ তিনিতো ২(৬৫) ধারার আওতায় শ্রমিক নন। এমতাবস্থায়, উক্ত ৩৩২ ধারার ব্যাপক সংস্কার ও সম্প্রসারণ এবং অন্যান্য ধারার সঙ্গে সমন্বয় দরকার।

শ্রম আইনের ৩৪৫ ধারার মূল বার্তা হ’ল নারী, পুরুষ কিংবা প্রতিবন্ধী নির্বিশেষে সমকাজের জন্য সমান মজুরী নির্ধারিত হবে; এইক্ষেত্রে কোন বৈষম্য করা যাবেনা। কতিপয় বিপজ্জনক কাজে নারী শ্রমিক নিযুক্ত করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে (৩৯, ৪০, ৪২, ৭৯ ও ৮৭ ধারা দ্রষ্টব্য)। পুরুষ ও নারী শ্রমিকের জন্য পৃথক ধৌতকরণ সুবিধার বিধান রয়েছে (৯১ ধারা)। তবে বিদ্যমান আইনে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের (ট্রান্সজেন্ডার) জন্য পৃথক ও পর্যাপ্ত ধৌতকরণ সুবিধাদি (ওয়াশরুম) ও টয়লেট থাকার বিধান করা প্রয়োজন।

এছাড়া ১০৯ ধারার বিধান হ’ল- কোন নারী শ্রমিককে তার অনুমতি ছাড়া রাত ১০ টা থেকে সকাল ছয়টার মধ্যে কাজে নিযুক্ত করা যাবেনা।

আর ঐ সময়ের মধ্যে অনুমতি সাপেক্ষে কাজ দরকার হলে সংশ্লিষ্ট মালিককে যথাযথ নিরাপত্তা ও মধ্যসময়ে কাজ শেষ হলে নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রসূতি কল্যাণজনিত কারণে মজুরীসহ যে ছুটি ও অন্যান্য সুবিধা এবং সুরক্ষা [যথাক্রমে ২(৩৪) ও ৪৫ থেকে ৪৯ ধারা এবং ৫০ ধারা] তা নারী শ্রমিকের প্রজনন স্বাস্থ্য এবং ভূমিষ্ঠ সন্তানের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা সম্পর্কিত। তবে এইক্ষেত্রে ২(৩৪) ও ৪৮ ধারার বিধানে কোন সংযোগ ও সমন্বয় না থাকায় নারী শ্রমিক মজুরীসহ ছুটি পেলেও অন্যান্য সুবিধাদি পাচ্ছেন না। এইক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নারী শ্রমিকের স্বাস্থ্যগত দিক, ঝুঁকি ও প্রয়োজন বিবেচনাপূর্বক বিশেষ স্বাস্থ্য ভাতা/বীমা (যেমনঃ প্রসূতি-বীমা), হাসপাতাল খরচ ভাতা ও পুষ্টিভাতার বিধান আইনে যোগ করা দরকার।

শ্রম আইনে নারী শ্রমিকের জন্য প্রযোজ্য কতিপয় বিদ্যমান বিধান বৈষম্যমূলক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল-

(ক) প্রসূতিকালীন ছুটি বা সুবিধা প্রাপ্তির সময়কাল হ’ল ১৬ সপ্তাহ। যা প্রজাতন্ত্রের নারী কর্মচারীদের জন্য ছয় মাস (২৬ সপ্তাহ)। এই অবস্থা সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদের বিধানের পরিপন্থী। এইক্ষেত্রে বেসরকারী খাতের জন্য প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে সমন্বয় আনার উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রকে। একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে চাকুরীর ধারাবাহিকতা।

(খ) কোন নারী শ্রমিক তার জন্য নির্ধারিত প্রসুতিকল্যান ছুটিতে যাওয়ার প্রাক্কালে তার গর্ভপাত ঘটলে তিনি প্রযোজ্য প্রসূতিকল্যাণ সুবিধা [ছুটি ও অন্যান্য সুবিধা, (২(৩৪) ধারা] পাবেন না। আইনে বলা হয়েছে তার স্বাস্থ্যগত কারণে ছুটির প্রয়োজন হলে তা ভোগ করতে পারবেন (৪৭ ধারা)। ২০১৮ সনে এই সংশোধনী আনা হয়; যা জটিলতা সৃষ্টি করেছে। এইক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নারী শ্রমিকের যে স্বাস্থ্যগত কারণে ছুটি লাগবে তা অবধারিত। কারণ গর্ভপাতে স্বাস্থ্যগত জটিলতা আরও বেশী হতে পারে। তিনি কাজে আসতে পারবেন না তা স্বাভাবিক। এই সুযোগে তার নৈমিত্তিক ছুটি (১১৫ ধারা), পীড়া ছুটি (১১৬ ধারা), বাৎসরিক ছুটি (১১৭ ধারা) ও উৎসব ছুটি (১১৮ ধারা) প্রভৃতি থেকে কর্তন বা সমন্বয় করা হয়; যা মূলতঃ বে-আইনি।
বিদ্যমান ৪৭ ধারায় যে “স্বাস্থ্যগত কারণে ছুটি” তা অন্য ছুটি থেকে আলাদা এবং স্ব-বেতন হতে হবে। কিন্তু আইনের অস্পষ্টতার অজুহাতে এবং সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের অজ্ঞতার সুযোগে এর অপব্যবহার হচ্ছে।

(গ) কোন প্রতিষ্ঠানের কোন মালিক কোন নারী শ্রমিকের সন্তান প্রসবের আগের আট সপ্তাহ এবং সন্তান প্রসবের পরবর্তী আট সপ্তাহ তাকে দিয়ে কোন কাজ করাতে পারবেন না। কোন নারী শ্রমিকেরও ক্ষেত্রেও সন্তান প্রসবের পর আট সপ্তাহ কাজে যোগদান নিষিদ্ধ। কিন্তু নারী শ্রমিকের সন্তান হওয়ার সম্ভাব্য তারিখের আট সপ্তাহ পূর্ব থেকে কাজ না করার উপর যে নিষেধাজ্ঞা তা চা বাগানে কর্মরতদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয় (৪৫ ধারা)। যা বৈষম্যমূলক বিধান।

(ঘ) শ্রম আইনে চাকুরী-অবসানজনিত যে আইনানুগ প্রাপ্য (ক্ষতিপূরণ বা গ্র্যাচুইটি) চা বাগানে কর্মরত শ্রমিকরা তার বাইরে। ২০১৮ সনে এই সংশোধন আনা হয়েছে। এতে করে নারী-পুরুষ উভয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও সংশ্লিষ্ট নারী শ্রমিকের উপর এর বিরূপ প্রভাব বেশী।

(ঙ) শ্রম আইনের ২৭ ধারার বিধান হ’ল কোন শ্রমিক কোন প্রতিষ্ঠানে তার চাকুরীর পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে পদত্যাগ করলে চাকুরীজনিত কোন সুবিধা (ক্ষতিপূরণ বা গ্র্যাচুইটি) নেই। এই বিধান বৈষম্যমূলক (সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদের আলোকে)। নারী-পুরুষ উভয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও সংশ্লিষ্ট নারী শ্রমিকের উপর এর প্রভাব বেশী। বিভিন্ন হিসাবে দেখা যায় যে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পখাতের শতকরা ২৫ থেকে ৩৫ ভাগ শ্রমিকের চাকুরীর বয়স পাঁচ বছরের নীচে। যাদের মধ্যে নারী শ্রমিক অধিক। ২৭ ধারার এই নিয়ম সংশোধন করে তা এক বছর করা দরকার।

অন্য দেশের উদাহরণ:
লিঙ্গ-সমতার আলোকে এখানে ভারতের একটি উদাহরণ তুলে ধরা যায়। তারা শ্রম ও শিল্প-সম্পর্ক বিষয়ক ৪০/৪৫ আইনকে ভাগ করে সম্প্রতি চারটি বিধি বা কোড তৈরি করেছে। যা এখন কার্যকর। এতে মজুরী বিষয়ক যে বিধি (যা ১ মার্চ ২০২১ গেজেটে প্রকাশিত হয়েছে) তাতে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করা হয়েছে (CHAPTER X: Special Provisions Relating to Employment of Women)। মাত্র দুইটি সংক্ষিপ্ত ধারা (৪৩ ও ৪৪ ধারা) নিয়ে এই অধ্যায়। এর মূল বিষয় হ’ল- নারীরা সকল ধরণের প্রতিষ্ঠানে সকল প্রকার কাজে নিযুক্ত হওয়ার অধিকারী হবেন। তাদের অনুমতি সাপেক্ষে সকাল ছয়টার আগে এবং সন্ধ্যা সাতটার পরেও কাজে নিযুক্ত করা যাবে; তবে এইক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা, সাপ্তাহিক ছুটি ও কর্মঘণ্টা অথবা অন্য কোন শর্তাবলীর বিষয়ে সরকার কর্তৃক ঘোষিত নিয়মাবলী সংশ্লিষ্ট নিয়োগকারীকে মান্য করতে হবে। কোন বিপজ্জনক কাজে নারীকে নিয়োগের বিষয়ে সরকার অতিরিক্ত সুরক্ষার বিধান করার বিষয় বিবেচনা করতে পারবে।

এটি লিঙ্গ-সমতার (জেন্ডার) প্রতি সংশ্লিষ্ট দেশের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। আমাদের এখানেও শ্রম আইনে লিঙ্গ-সমতার নিরিখে আলাদা অধ্যায় এবং ধারা যুক্ত করা দরকার।

কর্মক্ষেত্রে নারীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানী:
দেশে কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে এবং কর্মস্থলে নারী শ্রমিক ও কর্মচারীর প্রতি বৈষম্য মূলক আচরণ ও যৌন হয়রানী এক বাস্তবতা। এতে সরকারী-বেসরকারী অফিস (দপ্তর), ব্যাংক-বীমা, এনজিও- সব রয়েছে।

কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি যৌন হয়রানী প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিষয়ে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের যে নির্দেশনা তাতে উক্ত বৈষম্যমূলক আচরণ ও সমস্যার স্বীকৃতি রয়েছে। আমরা এর পরিসংখ্যানগত দিকে যাবো না।

একটি রীট পিটিশনের প্রেক্ষিতে (নং- ৫৯১৬/২০০৮) রায়ের মাধ্যমে নীতিমালার আলোকে মাননীয় আদালত বিগত ১৪ মে ২০০৯ তারিখে এক গুচ্ছ নির্দেশনা জারী করেন। এতে বলা হয় যে কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আচরণ ও যৌন হয়রানী প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কোন কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় উক্ত নির্দেশনা জারী করা হ’ল। প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কোন কার্যকর আইন প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদের আলোকে উক্ত নির্দেশনা আইন বলে গণ্য হবে।

মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের উক্ত নির্দেশনা দেশের সরকারী ও বেসরকারী সকল প্রকার প্রতিষ্ঠান (কর্মক্ষেত্র ও অফিস) ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য। এমনকি ইপিজেডে এবং বিশেষ শিল্প অঞ্চলে অবস্থিত সকল প্রতিষ্ঠান ও কারখানার জন্যও তা প্রযোজ্য হবে।

নির্দেশনায় নারীর প্রতি যৌন হায়রানী কি তার বিস্তারিত সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। কর্মক্ষেত্র (কারখানাসহ) ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রেক্ষাপটে সেই সংজ্ঞা হ’লঃ

(ক) যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ অযাচিত যে কোন প্রকার আচরণ, শারীরিক স্পর্শ কিংবা অগ্রসর হওয়া (যা সরাসরি বা পরোক্ষ হতে পারে);
(খ) প্রশাসনিক, অবস্থানগত অথবা পেশাগত ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে যৌন-উদ্দেশ্যমূলক শারীরিক ঘনিষ্ঠতার চেষ্টা বা উদ্যোগ;
(গ) যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মৌখিক উপস্থাপনা;
(ঘ) যৌন-সুবিধার জন্য দাবী বা অনুরোধ করা;
(ঙ) পর্ণগ্রাফি বা অশ্লীল ছবি/ভিডিও দেখানো;
(চ) যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কোন প্রকার মন্তব্য বা অভিবাদন জানানো;
(ছ) অশালীনভাবে কাউকে অভিবাদন জানানো, কুরুজিপূর্ণ কথা বলে কাউকে অপদস্থ করা, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কৌতুক বলা ইত্যাদি;
(জ) চিঠি, টেলিফোন-কল, মোবাইল ফোন কল, এসএমএস, ছবি এঁকে, নোটিশ, কার্টুন, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল, নোটিশ বোর্ড ও অফিসের দেওয়ালে লেখার মাধ্যমে, কারখানা, ক্লাশরুম ওয়াশরুম প্রভৃতিতে যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ লেখালেখি কিংবা আকাআকি।
(ঝ) ব্ল্যাকমেইল বা চরিত্রহননের উদ্দেশ্যে স্থিরচিত্র বা ভিডিওধারণ;
(ঞ) লিঙ্গ বিবেচনায় কিংবা যৌন হয়রানীর লক্ষ্যে কাউকে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সাংগঠনিক কিংবা শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণে বাঁধাদান;
(ট) ভালবাসার প্রস্তাবদান এবং উক্ত ভালবাসার প্রস্তাব প্রত্যাখাত হলে চাপ প্রয়োগ বা হুমকিদান;
(ঠ) ভয়ভীতি প্রদর্শন, প্রতারণা বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা।

উক্ত নির্দেশনায় যে সকল বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হ’ল- কোন কোন কার্যক্রম যৌন হয়রানী হবে সেই বিষয়ে, ভুক্তভোগীর উপর যৌন হয়রানীর প্রভাব এবং যে ব্যক্তি কাউকে যৌন হয়রানী করবে তার বিরুদ্ধে বিচার ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কি- সেইসব বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রচার-প্রচারনা করা।

কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা কারখানার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ উক্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য আইনগতভাবে দায়বদ্ধ। কোন প্রতিষ্ঠান চাইলে তার অসদাচরন সংক্রান্ত নীতিমালায় যৌন হয়রানীর বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। অন্যথায় এহেন ঘটনার প্রতিকার করতে অভিযোগ কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটি কমপক্ষে পাঁচজন সদস্য নিয়ে করতে হবে; কোন নারীকে উক্ত কমিটির প্রধান করা উচিত। আর কমপক্ষে দুই জন সদস্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কারখানা বা অফিসের বাইরের কেউ হবেন, যারা জেন্ডার বা নারীর প্রতি যৌন হয়রানী প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করে থাকেন।

এই দুই সদস্যকে বাইরে থেকে নেওয়ার বিধান দেওয়ার উদ্দেশ্য হ’ল কমিটি যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনাপক্ষের কোন প্রকার হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ও বাঁধাবিঘ্নহীনভাবে কাজ করতে পারেন। এই বিধান নতুন নয়। ভারতসহ অনেক দেশে অভিযোগ কমিটির ক্ষেত্রে এমন বিধান রয়েছে।

আরেকটি বিষয় অভিযোগ কমিটির কাজ কিন্তু সুনির্দিষ্ট। প্রাপ্ত অভিযোগের তদন্ত করে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ প্রদান। আর যৌন হয়রানীর গুরুতর অভিযোগ হলে তা সংশ্লিষ্ট আইন রক্ষাকারী সংস্থাকে অবিলম্বে জানাতে হবে। যা ভুক্তভোগী নিজে (এবং তার ইচ্ছামতে) করতে পারেন, তবে এই ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহায়তা করতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে।

কর্মক্ষেত্রে যৌন হায়রানীর বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির যে দায়িত্ব তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের। বছরে অন্ততঃ দুইবার এই ধরণের আয়োজন করা দরকার বলে নির্দেশনায় বলা হয়েছে।

সমস্যা যেখানে:
মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা বা নীতিমালা জারীর এক যুগ পূর্ণ হয়েছে গত ১৪ মে ২০২১। উল্লেখ্য, মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষগণ (সরকার- আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য) উচ্চতর আদালতে কোন আপীল করেননি। ফলে উক্ত রায় চূড়ান্ত হয়েছে। যে বেঞ্চ উক্ত রায় দিয়ে ছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ বিচারক এখন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি।

আর দুঃখের বিষয় হ’ল সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-অধিদপ্তর দীর্ঘ এক যুগেও উক্ত রায় তথা তার সংশ্লিষ্ট নির্দেশনার (নীতিমালার) মর্মার্থ, তাৎপর্য ও আইনি-বাধ্যকতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন কিংবা বুঝেননি।

আমাদের এখানে না হয়েছে কোন নতুন আইন। না হয়েছে উক্ত নির্দেশনার বাস্তবায়ন।

উক্ত রায় বা নির্দেশনা বাস্তবায়নের মূল দায় সরকারের (সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের মাধ্যমে) এবং সকল প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের।

তবে উল্লেখ্য যে, উক্ত রায় বা নির্দেশনাকে বা নীতিমালাকে পাশ কাটিয়ে কতিপয় আন্তর্জাতিক সংস্থা যে সকল কার্যক্রম করেছে তাতে নানান বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। তারা মূলতঃ এসব করেছে উক্ত রায় ও নির্দেশনাকে দৃশ্যতঃ অগ্রাহ্য করে; তাদের নিজস্ব কিংবা সংশ্লিষ্ট দাতাসংস্থার এজেণ্ডা মাথায় রেখে। কিছু স্থানীয় সংস্থাও তাতে সহযোগী হয়েছে। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যা সরাসরি আদালত অবমাননার সামিল বটে এবং সংবিধানের ১১১ ও ২১ অনুচ্ছেদের বিধানের লঙ্ঘন। এই অবহেলা কিংবা গাফিলতি অমার্জনীয়।

যা করা দরকার:
অবিলম্বে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের উক্ত নির্দেশনা বা নীতিমালার বাস্তবায়ন করা দরকার। এইক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে।

একইসঙ্গে যৌন হয়রানী প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিষয়ে অবিলম্বে আইন করা দরকার। নির্দেশনায় বা নীতিমালায় যে সকল বিষয়ে বিভ্রান্তি কিংবা অসম্পূর্ণতা রয়েছে আইন তৈরির সময় বিদ্যমান সময় ও প্রয়োজনের আলোকে তার সমাধান সম্ভব। এইক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের আইনকে উদাহরণ হিসেবে দেখা যাতে পারে।

আমাদের মত হ’ল- কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানীকে প্রতিরোধ ও মোকাবেলা করার জন্য পৃথক আইন করা দরকার। যা সরকারী-বেসরকারী সকল অফিস (দপ্তর), এনজিওসহ সকল প্রকার প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, কারখানা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনায় ও এখতিয়ারে নিয়ে করতে হবে।

শ্রম আইনে যৌন হয়রানী বিষয়ে বিধান যুক্ত করা (আলাদা অধ্যায় বা ধারা করার মাধ্যমে) কোন বাস্তবসম্মত সমাধান মিলবে না। এই ক্ষেত্রে কিছু দৃশ্যমান কারণ হ’ল- শ্রম আইন শুধুমাত্র শ্রমিকদের (ও মালিক) জন্য প্রযোজ্য। ফলে বিভিন্ন দপ্তর, প্রতিষ্ঠান ও কারখানায় কর্মরত যে সকল নারী শ্রমিক-সংজ্ঞার বাইরে (প্রশাসনিক, তদারকি কিংবা ব্যবস্থাপনামূলক দায়িত্বে নিয়োজিত হওয়ার কারণে) তাদের কি হবে? যে সকল নারী সরকারী কর্মচারী বা কর্মকর্তা তারা?

একই সঙ্গে যৌন হয়রানীকে শ্রম আইনে সংযুক্ত করলে তখন শ্রম আদালতে তার বিচার হতে হবে। কিন্তু শ্রম আদালতের বিচার-পদ্ধতি সংক্ষিপ্ত। তা দেওয়ানী কার্যবিধি (দেওয়ানী মামলার ক্ষেত্রে) এবং ফৌজদারী কার্যবিধির সংক্ষিপ্ত বিচার-পদ্ধতি অনুসরন করেন। তাই বিবেচ্য হ’ল অধিকতর সাজার ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত বিচারের সুযোগ নেই।

যৌন হায়রানীর অপরাধের যে ব্যাপকতা তা পৃথক আইনের আওতায় প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা দরকার। এইক্ষেত্রে দুইটি দেশের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারেঃ শ্রীলঙ্কা তাদের দণ্ডবিধিতে (পেনাল কোড) প্রয়োজনীয় সংশোধন এনেছে (১৯৯৫ সনে)। সেখানে যৌন হয়রানীর সংজ্ঞা, বিচারের জন্য এখতিয়ারসম্পন্ন আদালত, অপরাধের শাস্তি প্রভৃতি বিধানে আনা হয়েছে। তাদের সংজ্ঞা কর্মক্ষেত্রসহ সকল প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে। এখানে যৌন হয়রানীকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে নারী-পুরুষ যে কেউ ভিকটিম হলে উক্ত আইনে প্রতিকার পাবেন। শাস্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড বা জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ড। একই সঙ্গে ভিকটিমের জন্য ক্ষতিপূরণের বিধান রয়েছে।

একই বিষয়ে ভারত ২০১৩ পৃথক আইন করেছে। যা হয়েছে মূলতঃ ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের বিখ্যাত বিশাখা মামলার রায়ের আলোকে (১৯৯৭)। ভারতের আইনের নাম হ’ল- The Sexual Harassment of Women at Workplace (Prevention, Prohibition and Redressal) Act, 2013; এখানকার উদ্যোগ কর্মক্ষেত্র ভিত্তিক; যার মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানীকে অসদাচরণ হিসেবে দেখা হয়েছে। তবে একই সঙ্গে তাদের দণ্ডবিধির আওতায় ৩৫৪ ধারা (নারীর সম্ভ্রমহানীঃ শাস্তি- এক থেকে পাঁচ বছর জেল ও জরিমানা), ৩৫৪-ক ধারা (পুরুষ কর্তৃক যৌন হয়রানীঃ শাস্তি- তিন বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা), ৫০৯ ধারা (নারীর সম্ভ্রমের উপর আক্রমণঃ শাস্তি- তিন বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা) প্রভৃতির আওতায় নারীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানীর প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এতে ২০১৩ সনের আইন কোন বাঁধা নয়।

আমাদের দণ্ডবিধির অবস্থান:
বাংলাদেশে দণ্ডবিধি এবং অন্য আইনের বিদ্যমান বিধানে কর্মক্ষেত্রে (ও অন্যত্র) যৌন হয়রানীর প্রতিকার সম্ভব। তবে সেইক্ষেত্রে হয়তো সংশ্লিষ্ট বিধানাবলী সময়ের বাস্তবতা ও প্রয়োজনের সঙ্গে পুরাপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দরকার হবে বিদ্যমান অন্য আইনের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয়। যেমনটি করেছে শ্রীলংকা।

কোন নারীর প্রতি হামলা অথবা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ, যার লক্ষ্য হ’ল তার সম্ভ্রমহানী সেইক্ষেত্রে সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে যার মেয়াদকাল হবে সর্বোচ্চ দুই বছর, অথবা জরিমানা অথবা উভয়বিধ শাস্তি হতে পারে (দণ্ডবিধির ৩৫৪ ধারা)।

একই আইনের ৫০৯ ধারায় বিধান হ’ল- কোন নারীর সম্ভ্রমহানীর উদ্দেশ্যে কোন উক্তি, কোন শব্দ উচ্চারণ কিংবা অঙ্গভঙ্গি, অথবা কোন বস্তু প্রদর্শন, যার উদ্দেশ্য হ’ল উক্ত নারীকে উক্ত উক্তিটি শুনানো অথবা প্রদর্শিত বস্তু দেখানো, অথবা উক্ত নারীর ব্যক্তিগত বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ, সেইক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা জরিমানা কিংবা উভয়বিধ শাস্তি হতে পারে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (২০০০ সনের ৮ নং আইন) যৌন নিপীড়নের প্রতিকার দিয়ছে। উক্ত আইনে ২০০৩ সনে এক সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিধান যুক্ত করা হয় [নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০৩ (২০০৩ সনের ৩০ নং আইন)]। সংশোধিত ১০ ধারা অনুসারে, কোন ব্যাক্তি কোন নারীর শ্লীলতাহানী করলে তার এই কাজ যৌন পীড়ন হবে (যা মূলতঃ যৌন হয়রানী); এর শাস্তি হ’ল অনধিক ১০ বছর কিংবা অনুন্য তিন বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ড হতে পারে।

কিন্তু জটিলতা হ’ল কেউ কোন ব্যক্তি মালিকানাধীন বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বা কারখানায় (যা শ্রম আইনের আওতাভুক্ত) কোন নারীর (আইনে “মহিলা” বলা হয়েছে) বিরুদ্ধে অশ্লীল কিংবা অভদ্রজনোচিত বলে গণ্য হতে পারে এমন কোন আচরণ কিংবা যা উক্ত নারীর শালীনতা ও সম্ভ্রমের পরিপন্থী কোন আচরণ করলে তার প্রতিকার হতে হবে শ্রম আইনের ৩৩২ ধারা মোতাবেক। কারণ বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শ্রম আইনের বিধান প্রাধান্য পাবে (শ্রম আইনের ৩৫০ ধারা মোতাবেক)। আর শ্রম আইনের আওতায় উল্লেখিত অপরাধের শাস্তি হ’ল ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড (৩০৭ ধারা)। অন্য আইনে যা দুই বা ১০ বছর জেল।

কাজেই দেখা যাচ্ছে যে এখানে বেসরকারী পর্যায়ের কোন প্রতিষ্ঠান বা কারখানায় নারীর শ্লীলতাহানীর (যা যৌন হয়রানীর অনুষঙ্গ) ঘটনা ঘটলে তার প্রতিকার করতে হবে শ্রম আইনের বিদ্যমান বিধানের আলোকে (৩৩২ ধারা)। এইক্ষেত্রে দণ্ডবিধি কিংবা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অধিক শাস্তি থাকলেও তার আওতায় যাওয়ার সুযোগ সীমিত; শ্রম আইনের ৩৩২ ধারা (যা অসম্পূর্ণ) ও ৩৫০ ধারার বিধানের কারণে।

তবে সরকার-নিয়ন্ত্রিত বা সরকারী আইন-তহবিলে পরিচালিত কোন অফিস বা প্রতিষ্ঠান কিংবা কোন প্রতিষ্ঠানে (যেখানে বিদ্যমান শ্রম আইন প্রযোজ্য নয় সেখানে) যৌন হয়রানীর কোন ঘটনা ঘটলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের বিদ্যমান ধারায় তার প্রতিকার পেতে কোন বাঁধা নেই। যেমন- মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, কর্পোরেশন, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সরকারী অফিস, সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি।

কাজেই, সংশ্লিষ্ট ভিকটিম, কর্মস্থল ও সমাজের উপর যৌন হয়রানীর মতো অপকর্মের প্রভাব এবং অপরাধের ব্যাপকতা বিবেচনায় উক্ত বিষয়ের প্রতিরোধ, প্রতিকার ও দোষীর শাস্তি বিধানের জন্য সমন্বিত আইন তৈরির প্রয়োজন এখন সর্বজনবিদিত। যা করতে হবে তা হ’ল শ্রম আইনে থেকে পৃথক এক আইনের মাধ্যমে। এজন্য মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনার বিষয়বস্তু এবং অন্য দেশের প্রাসঙ্গিক আইনকানুনকে বিবেচনায় নিতে হবে।

একই সঙ্গে বিদ্যমান অন্য আইনের (বা সংশ্লিষ্ট ধারা) প্রেক্ষিতে সৃষ্ট নতুন আইন বা বিধানের অগ্রাধিকার ও প্রয়োগযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য তার প্রাধিকারমূলক ধারা যুক্ত করতে হবে।


ড. উত্তম কুমার দাস, এডভোকেট, হাইকোর্ট বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। শ্রম ও চাকুরী-সংক্রান্ত আইনে অভিজ্ঞ আইনজীবী এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর সাবেক ঊর্ধ্বতন জাতীয় পরামর্শক। ই-মেইলঃ [email protected]

ঢাকা, ১৫ মে ২০২১।