আব্দুল আলিম: নভেল করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বিশ্বের জুড়ে চলছে লকডাউন। কার্যত থমকে গেছে মানুষের জীবন-জীবিকা। ধ্বংসের মুখে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি। অর্থনৈতিক এক মহাবিপর্যয়ের পথে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও। দুর্ভিক্ষের মতো কঠিন বাস্তবতার ঢলে পড়ছে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্ব। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
করোনা সংকটে সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে অর্থনীতির প্রাণশক্তি তৈরী পোশাক পোশাক শিল্পে। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের দেশে দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ায় গত মাসে বিপুলসংখ্যক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করেছে বিদেশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। বিজিএমইএ ও ইপিবির তথ্যানুযায়ী শুধুমাত্র পোশাক কারখানার ক্ষতি প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের (৪২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা)। চলমান এই সংকটে এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপণ করাও প্রায় অসম্ভবই।
করোনা মোকাবেলায় সরকারের নেয়া নানামূখী পদক্ষেপ দেশের করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। নানা সিদ্ধান্তহীনতার শেষে সরকারী ছুটির সাথে তাল মিলিয়ে প্রায় পুরো এক মাস ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে পোশাক শিল্পের চাকাও। পুরো একমাস জুড়েই করোনা সংকটের নানা খবরের মাঝেও সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত খবরে এগিয়ে ছিল দেশের তৈরী পোশাক শিল্প। পোশাক শিল্পের মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র আদেশ, নির্দেশ, আহ্বান, অনুরোধ আর ঘোষণার গ্যাড়াকলে সরকার-মালিক-শ্রমিকের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। চরম আতঙ্ক আর বিপদে পড়েছে সাধারণ শ্রমিকরা। মালিকরা ভুগছে ইমেজ সংকটে। পরিস্থিতি সামলাতে বেগ পেতে হয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত প্রশাসনের। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের প্রজ্ঞাপন, নিদের্শনা, জরুরী ঘোষণা আর বিজিএমইএ’র অনুরোধ আর আহ্বানের সমন্বয়হীনতার চাপে অনিশ্চয়তার মধ্যে শ্রমিক। মরার উপর খরার ঘাঁ পেয়েছে অনেক কারখানা মালিকরা। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে অনেকে।
বিগত দিনের পরিস্থিতি যাই হোক, আজকের আলোচ্য বিষয় ভিন্ন। বর্তমান সময়ে সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পথে। এই বিপর্যয় ঠেকাতে ধীরগতিতে হলেও শিল্প-কারখানায় উৎপাদন শুরু করতে হবে। অর্থনৈতিক কার্যাক্রম পরিচালনা শুরু করতে হবে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি না হলেও করোনা ভাইরাসের প্রভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয় আসার সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে প্রাণ যাবে বিশ্বব্যাপি প্রাণ যাবে কোটি মানুষের। এমতাবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালু করার পক্ষেই মত দিচ্ছে বিশ্বের খ্যাতনামা অর্থনীতি ও সমাজবিদরা।
কারখানা খোলা না খোলা নিয়ে নানা শঙ্কা শেষে সম্প্রতি কারখানা মালিকদের সংগঠন থেকে সীমিত আকারে কারখানা কথা ভাবছেন। তবে বাংলাদেশের অক্সিজেনসম এই শিল্পখাতের মালিক-শ্রমিক-কর্মকর্তাগন যাতে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে না পড়ে এজন্য দরকার সকল বিভাগের সমন্বিত প্রস্তুতি।
সরকার ও মালিক পক্ষের সংগঠন থেকে বলা হচ্ছে সীমিত আকারে উৎপাদন কার্যক্রম চালু হবে। ধাপে ধাপে কার্যক্রমের পরিধি বাড়বে। ঢাকার বাইরের শ্রমিকদের না ডাকতে অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু আজকের বিভিন্ন গণমাধ্যমের চিত্র বলছে উল্টো। বিভিন্নভাবে শ্রমিকদের ঢাকা আসার চিত্র প্রকাশিত হচ্ছে গণমাধ্যমে। এবারের সিদ্ধান্তেও যেনো সমন্বয়হীনতার ছাপ স্পষ্ট।
গণ পরিবহন বন্ধ। কিন্তু ২৬ তারিখ অনেক কারখানা খোলার সিদ্ধান্তে দেশের নানা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শ্রমিকরা হেঁটেই ছুটেছে কর্মস্থলের পথে। সীমিত আকারে কারখানা চলবে, গ্রামের শ্রমিক শহরে না ডাকার প্রতিশ্রুতি থাকলেও কারখানাগুলো হয়তো গ্রামের চলে যাওয়া শ্রমিকদের কর্মে যোগ দেয়ার তাগাদা দিয়েছে অথবা তাদের গ্রাম থেকে না আসার জন্য বলা হয়নি অথবা গ্রাম থেকে না আসার আহবান তাদের পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। মালিক সংগঠনের সিদ্ধান্ত, কারখানা মালিকের সিদ্ধান্ত ও শ্রমিকের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়ানো চরম সমন্বয়হীনতাই ইঙ্গিত করে।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমনের রেডজোন ঘোষিত এলাকা নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুর দেশের সবচেয়ে বড় দুইটি শিল্পাঞ্চল। এসব এলাকায় কঠোর লকডাউন চলছে। কিন্তু এসব এলাকায় শ্রমিকরা কিভাবে কর্মস্থলে নির্বিঘ্নে যোগদান করতে পারবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এসব এলাকায় কি লকডাউন শিথিল ঘোষণা হবে?
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাথে পোশাক কারখানা মালিকদের বৈঠক থেকে উভয় পক্ষ থেকেই কারখানা খোলার ইতিবাচক সাড়া মিলেছে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রত্যেক দিনের ব্রিফিং থেকে ঘরের বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। জনপ্রশাসন অধিদপ্তর ছুটি বাড়িয়েছেন। গণ পরিবহণ চলাচল বন্ধ রেখেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। বিভিন্ন দপ্তরের এমন ভিন্ন সিদ্ধান্তে দিশেহারা পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা।
দেশের অর্থনীতি সচল করতে শিল্প উৎপাদন চালু করতে হবে। এর বিকল্প নেই। সেই সাথে সকল দপ্তরের সিদ্ধান্তে একটা সমন্বয় রাখা জরুরী। লকডাউন সময়ে শ্রমিকদের প্রতি প্রশাসনের আচরণ কেমন হবে, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিদের্শনা কেমন হবে, স্থানীয় জনসাধারণের আচরণ কেমন হবে এসবের সমন্বিত প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে হবে। না হলে স্থানীয় জনরোষ, মালিক শ্রমিকের সম্পর্ক নষ্ট ও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মহামারী আকার ধারণ করার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
তাই এই মুহুর্তে জনমানুষের কল্যাণে যৌথ সমন্বিত সিদ্ধান্ত আর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা আর ঘোষিত যথাযথ স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার মাধ্যমে চালু হোক শিল্প উৎপাদন। সচল হোক দেশের অর্থনীতির চাকা। সংকট মোকাবেলায় আসুন বাঁচি একসাথে।
লেখক: সম্পাদক, দি আরএমজি টাইমস
ই-মেইল: [email protected]
মতামত লিখুন :