ড. উত্তম কুমার দাস: ভদ্রলোক একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরী করেন । তাঁর চাকরীর অবসান নিয়ে দু’ধরণের বক্তব্য পাওয়া গেল- তাঁকে কথিত দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রকল্প (Performance Enhancemnt Project) নিতে বলা হয় । এ নিয়ে তাঁর সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি । এতেই শেষ নয় । পরদিন হাতে ধরিয়ে দেওয়া হ’ল “টার্মিনেশন লেটার” (“Letter of Termination”)।
তাঁর সহকর্মীদের মতে, ঐ প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে- যা নিয়ে মামলা চলছে । ভদ্রলোক নিজে ইউনিয়নের নির্বাহী কমিটিতে না থাকলেও তাদের কাজে “সহযোগিতা” করতেন । এই কারণেই কথিত টার্মিনেশনের আবরণে তাঁর চাকরীর অবসান করা হয়েছে । এখানে কোন আইনী প্রতিকার আছে কি ?
পরামর্শঃ
প্রাপ্ত তথ্য মতে, প্রতিষ্ঠাননি বেসরকারী, তাই বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫- এর বিধান প্রযোজ্য হবে ।
সংশ্লিষ্ট চাকরীজীবী (Employee) বা শ্রমিকের (Worker) নিয়োগ ও চাকরীর শর্তাবলী নিয়ে কোন ক্ষোভ তৈরি হলে তিনি শ্রম আইনের ৩৩ ধারা অনুসারে প্রতিকার চাইতে পারেন ।
অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট কারও ক্ষেত্রে (কেউ যদি মনে করেন) যেভাবে বা প্রক্রিয়ায় তাঁর লে-অফ, ছাঁটাই, ডিসচার্জ, বরখাস্ত, অপসারণ অথবা অন্য কোন কারণে চাকরীর অবসান হয়েছে (টার্মিনেশন) হয়েছে কিংবা চাকরীর অন্য শর্তাবলী পরিবর্তন করা হয়েছে তা যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে হয়নি বা আইনানুগ হয়নি, তবে তিনি তার প্রতিকার চাইতে পারেন । যাকে অনুযোগ-পদ্ধতি (Grievance Mechanims) বলে (শ্রম আইন, ৩৩ ধারা) । এই অনুযোগ-পদ্ধতি একটি বিধিবদ্ধ বা আইনী প্রক্রিয়া (Statutory Procedure); কোন বিকল্প-বিরোধ নিষ্পত্তি নয় ।
উল্লেখিত ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি (শ্রমিক) যদি মনে করেন যে, তিনি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন, প্রযোজ্যমতে আত্মপক্ষ সমর্থনের যথাযথ সুযোগ পাননি (যেমন- অসদাচরণের জন্য কারণে কাউকে বরখাস্ত করার ক্ষেত্রে) তবে তিনি শ্রম আইনের ৩৩ ধারা মতে তাঁর অভিযোগ বা অনুযোগ দিতে পারেন । তিনি কেন ক্ষতিগ্রস্ত এবং কি প্রতিকার চান তা আবেদনে উল্লেখ করতে হবে । আর অভিযোগের ঘটনা ঘটার বা সে সম্পর্কে জানার ৩০ দিনের মধ্যে এই অভিযোগ করতে হবে । সংশ্লিষ্ট মালিক বা নিয়োগকারী বরাবরে । অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান বা কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবরে । অন্য কাউকে অনুলিপি দেওয়া যাবে- দরকার হলে ।
এহেন অভিযোগ সরাসরি দাখিল করলে প্রমাণের জন্য প্রাপ্তি-স্বীকার রাখতে হবে । অন্যথায় তা রেজিস্ট্রি ডাকে দিতে হবে । রেজিস্ট্রি করার তারিখ অভিযোগ দাখিলের দিন বলে গন্য হবে ।
মালিক বা নিয়োগকারীর দায়িত্ব-
সংশ্লিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পর মালিক বা নিয়োগকারীরও দায়িত্ব রয়েছে- আবেদন পাওয়ার পর ৩০ দিন সময় পাবেন তিনি । এর মধ্যে প্রযোজ্যমতো তদন্ত করা, অভিযোগকারীকে শুনানীর সুযোগ দিয়ে আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে (অভিযোগকারীকে) জানাতে হবে । এইক্ষেত্রে মালিকের ব্যর্থতায় কিংবা প্রাপ্ত সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মাননীয় শ্রম আদালতে মামলা করতে পারবেন । এই ক্ষেত্রেও সময় ৩০ দিন- মালিক বা নিয়োগকারী থেকে সিদ্ধান্ত পাওয়ার দিন থেকে ।
যিনি চাকরীতে বহাল আছেন এমন এবং যার চাকরীর অবসান হয়েছে (লে-অফ, ছাঁটাই, ডিসচার্জ, বরখাস্ত, অপসারণ অথবা অন্য কোন কারণে চাকরীর অবসান হয়েছে)- দু’ধরনের শ্রমিকই শ্রম আইনের ৩৩ ধারায় প্রতিকার চাইতে পারেন । তবে এই ক্ষেত্রে প্রথমে সংশ্লিষ্ট মালিক বা নিয়োগকারীর কাছে অভিযোগ বা অনুযোগ দিতে হবে; এতে ব্যর্থ হলে তারপর মাননীয় শ্রম আদালতে যাওয়া যাবে । সরাসরি নয় ।
আর চাকরীতে নিয়োজিত কোন শ্রমিকের কোন অধিকার বাস্তবায়নের জন্য সরাসরি মাননীয় শ্রম আদালতে যাওয়া যাবে (শ্রম আইন, ২১৩ ধারা) । এইক্ষেত্রে আগে অনুযোগ দেওয়ার কোন দরকার নেই । মাননীয় হাই কোর্ট বিভাগ এক রিট মামলায় এই বিষয় স্পষ্ট করেছেন (রবি এক্সিয়েটা বনাম চেয়ারম্যান, প্রথম শ্রম আদালত, ঢাকা) । স্বনামখ্যাত মাননীয় বিচারপতি ড. সেয়দ রেফাত আহমেদ (Syed Refaat Ahmed) এই রায় দিয়েছেন ।
বরখাস্ত ছাড়া অন্য কোনভাবে মালিক কর্তৃক শ্রমিকের চাকরীর অবসান হলে (টার্মিনেশন, ধারা ২৬) সাধারণতঃ কোন অনুযোগ বা অভিযোগ করা যায় না- এটি আমাদের সাধারণ ধারণা । তবে সংশ্লিষ্ট চাকরী-অবসান-আদেশ (টার্মিনেশন হলেও) যদি সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত কাজ অথবা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হয়ে থাকে তবে ৩৩ ধারায় অভিযোগ করা যাবে । আর টার্মিনেশন-সুবিধা না পেলেও (যদি যথাযথভাবে নোটিশ দেওয়া হয় কিংবা তার বদলে নোটিশ-পে এবং আইনানুগভাবে অন্যান্য পাওনাদি পরিশোধ করা হয়) অনুযোগ দেওয়া যাবে [শ্রম আইন, ৩৩(৯) ধারা] । ঘটনা পরস্পরা ও সাক্ষ্যপ্রমাণে এই উদ্দেশ্য প্রমাণ করতে হবে । এই টার্মিনেশন যদি উদ্দেশ্যমূলক হয় কিংবা আইনানুগ না হয় তবে মাননীয় হাই কোর্ট বিভাগে রীট আবেদনের মাধ্যমেও প্রতিকার চাওয়া সম্ভব । (বেসরকারী নিয়োগকারীর বিরুদ্ধেও রীট আবেদন চলতে পারে- এমন সিদ্ধান্ত মাননীয় আদালত দিয়েছেন ) ।
প্রশ্ন উঠবে- কে শ্রমিক ?
শ্রম আইন অন্ততঃ চার জায়গায় শ্রমিকের সংজ্ঞা দিয়েছে । এর একটি মৌলিক সংজ্ঞা রয়েছে; সেমতে, যার কাজের শর্ত আছে, যিনি অর্থের বিনিময়ে কাজ করেন, এবং দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরী, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরানীগিরির কাজ করেন- তিনিই শ্রমিক [শ্রম আইন ২(৬৫) ধারা] ।
যদিও শর্ত রয়েছে যিনি প্রধানতঃ প্রশাসনিক, তদারকি কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা শ্রমিক-সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবেন না । তবে মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট একাধিক মামলার রায়ে শ্রমিকের সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করেছেন । আদালত বলেছেন- কারও পদবী দেখে বলা যাবে না কে শ্রমিক আর কে শ্রমিক নয় ।
আর মাননীয় লেবার আপীলেট ট্রাইব্যুনাল তো এক রায়ে (২০১৬) শ্রম বিধিমালায় “তদারকি কর্মকর্তা” এবং “ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির” যে সংজ্ঞা তাকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন । আদালতের মতে, যেহেতু মূল আইনে এমন সংজ্ঞা নেই, তাই বিধিদ্বারা তা করা বৈধ হয়নি ।
লেখক: এডভোকেট, সুপ্রীম কোর্ট অব বাংলাদেশ এবং শ্রম আইনে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী । মতামত তাঁর ব্যাক্তিগত, একজন আইনজীবী ও বিশ্লেষক হিসেবে ।
ই-মেইলঃ [email protected]
মতামত লিখুন :