কর্মক্ষেত্রে প্রথম দেখায় তৈরি হওয়া ধারণা একজন মানুষের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের পথ খুলে দিতে পারে। এই মূল মন্ত্রটি একটি ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি।
একটি স্বনামধন্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, রাকিব সাহেব, উদার এবং মুক্তমনা স্বভাবের। তিনি তার অধীনস্থদের সহকর্মী হিসেবেই ভাবতে ভালোবাসেন। একদিন তার সহকর্মী সোহেল সাহেব, পদমর্যাদায় বেশ নিচে হলেও, বিনয়ের সাথে রাকিব সাহেবকে তার মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালেন। আমন্ত্রণটি ছিল “গরিবের বাসায় পদধূলি” দেওয়ার অনুরোধ। রাকিব সাহেব সায় দিতেই সোহেল সাহেব কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলেন এবং কক্ষ ত্যাগ করলেন। কিন্তু গল্পটি শুধু এই আমন্ত্রণেই শেষ নয়। সোহেল সাহেবের বাড়িতে সেই প্রথম পরিদর্শনের পর থেকে রাকিব সাহেব তাকে বিশেষভাবে স্নেহ করতে শুরু করলেন।
এর কারণ কী ছিল? নিশ্চয়ই ভাবছেন, কোনো অসাধারণ আপ্যায়ন বা মজাদার খাবার? কিন্তু সবাই তো শুধু আপ্যায়নেই তুষ্ট হন না, বিশেষ করে রাকিব সাহেবের মতো ব্যতিক্রমী মানুষরা। তার ভালো লাগার শুরুটা হয়েছিল সোহেল সাহেবের বৈঠকখানায় (শহুরে ভাষায় ড্রইং রুম) প্রবেশ করার পরই। এর মানে এই নয় যে, ড্রইং রুমে প্রচুর দামি বা বিরল সামগ্রী ছিল। বরং, সেখানে ছিল একটি সাধারণ সোফাসেট, একটি বইয়ের আলমারি, একটি টিভি, একটি সেন্টার টেবিল (যাতে সতেজ গোলাপের ফুলদানি), এবং দু-তিনটি সাধারণ পেইন্টিং।
তাহলে রাকিব সাহেবের মন কীভাবে প্রভাবিত হলো? মূল কারণ ছিল ঘরটির পরিপাটি ও সুসজ্জিত অবস্থা। যত দামি বা কম দামি জিনিসই থাকুক না কেন, ড্রইং রুমটি ছিল নিঁখুতভাবে সাজানো, কোথাও কোনো অগোছালো ভাব ছিল না। মনে হচ্ছিল যেন শিল্পী তার ক্যানভাসে যত্ন নিয়ে প্রতিটি রেখা টেনেছেন! যদিও রাকিব সাহেব সোহেল সাহেবকে দীর্ঘদিন ধরে চিনতেন, এটি ছিল তার প্রথমবার সোহেল সাহেবের বাড়িতে যাওয়া। এই প্রথম দেখাতেই সোহেল সাহেবের রুচি ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি তার মুগ্ধতা জন্মাল। এটিই হলো প্রথম ইমপ্রেশন – যা অনেক সময় বাংলায় অনুবাদ করলে তার গভীরতা হারায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, মানুষ কেন তার ড্রইং রুম সাজিয়ে রাখে? সম্ভবত অতিথিকে আকৃষ্ট করতে, যেন অতিথি তার সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ধারণা পান। সোহেল সাহেবের মেয়ের বয়স মাত্র তিন বছর হওয়া সত্ত্বেও তার ড্রইং রুমটি পরিপাটি ছিল। এর পেছনের কারণ ছিল তার ঊর্ধ্বতনকে সম্মান জানানো এবং নিজেকে ভালোভাবে উপস্থাপন করার ইচ্ছা। তিনি চেয়েছিলেন যেন তার ব্যাপারে মানুষের মনে একটি ভালো ধারণা থাকে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন মানুষ প্রথম সাক্ষাতে অন্য মানুষের সম্পর্কে যে ধারণা লাভ করেন, তা দীর্ঘকাল তার মনে গেঁথে থাকে। তাই *প্রথম ইমপ্রেশন* অত্যন্ত জরুরি। চাকরি বাজারে অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন যারা হয়তো এই বিষয়টি আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন। আমি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান থেকে কিছু সহজ টিপস দেওয়ার চেষ্টা করব, যা পাঠকদের কাজে লাগবে আশা করি।
চাকরির ক্ষেত্রে একজন প্রার্থীর প্রবেশদ্বার হলো তার সিভি, যা তাকে ইন্টারভিউ বোর্ড পর্যন্ত নিয়ে যায়। আর সেই ইন্টারভিউ বোর্ডই হলো নিয়োগকর্তার কাছে নিজেকে প্রথমবার উপস্থাপন করার এবং একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরির সুযোগ। এই সুযোগটিকে কাজে লাগানো অপরিহার্য। নিজেকে প্রশ্ন করুন: যদি কোনো এক্সিকিউটিভ-স্তরের ডেস্ক-নির্ভর চাকরির জন্য আবেদন করে থাকেন, যেখানে অনেক মানুষের সাথে কথা বলতে হবে এবং টিম পরিচালনা করতে হবে, তাহলে নিয়োগকর্তারা আপনার কাছে কী আশা করবেন? নিঃসন্দেহে তারা একজন পরিপাটি, মিষ্টভাষী এবং বুদ্ধিমান প্রার্থীকে চাইবেন। সেক্ষেত্রে প্রার্থীর উপস্থাপন, তার বাচনভঙ্গি, এবং অবশ্যই তার বেশভূষা—সবকিছুই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, ইন্টারভিউ বোর্ডে তেমনই প্রস্তুত হয়ে যেতে হবে। মনে রাখবেন, নিজেকে নিজেই উপস্থাপন করতে হবে এবং নিজের যোগ্যতা দিয়ে নিয়োগকর্তাদের প্রভাবিত করতে হবে। আপনার তৈরি করা প্রথম ধারণাই আপনাকে চাকরি পাওয়ার সুযোগ করে দেবে। টিভির বিজ্ঞাপনগুলোর দিকে তাকান; কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন এখনই তা কিনে ফেলতে ইচ্ছে করে। চাকরির ক্ষেত্রেও প্রার্থীকে নিজেকে ‘বিক্রি’ করতে হবে, এবং তার জন্য সবকিছুই গোছানো থাকা চাই।
আপনি হয়তো বলতে পারেন, “আমি ইংরেজিতে ততটা পারদর্শী নই, আর নিয়োগকর্তারা এমন প্রার্থী খুঁজছেন যারা ইংরেজিতে সাবলীল।” কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, বাংলাদেশের অনেক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা শিক্ষিত বেকাররাও তো আপনার মতোই গড়পড়তা ইংরেজিতে কথা বলেন, তাহলে তারা চাকরি পাচ্ছেন কীভাবে? দুর্নীতির প্রভাব একেবারেই নেই, তা বলা যাবে না; তবে সব নিয়োগকর্তা তো একরকম নন। নিজেকে প্রশ্ন করুন, যার কোনো ‘মামা-চাচা’ নেই, তিনি কীভাবে চাকরি পান? নিয়োগকর্তারা ভালো করেই জানেন যে আপনি হয়তো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েননি, তাই তারা আপনার কাছে একজন নেটিভ ইংলিশ স্পিকারের মতো নিখুঁত বাচনভঙ্গি আশা করবেন না। যদি তাদের তেমনটাই প্রয়োজন হতো, তবে তারা লন্ডনের কোনো ইংরেজি দৈনিকে বিজ্ঞাপন দিতো, আপনাকে ডাকতো না। তাহলে আপনাকে ডাকার পেছনে কারণ কী, আর আপনার কাছে তারা আসলে কী চান? যেহেতু আপনার সিভি দেখে তারা আপনাকে ডেকেছেন, তার মানে আপনি তাদের প্রাথমিক মানদণ্ড পূরণ করেছেন। এক্ষেত্রে নিশ্চিত হোন যে আপনার সিভিতে যা লিখেছেন, তা কারো থেকে কপি-পেস্ট করা নয়। যদি তা হয়ে থাকে, তবে আপনি এই চাকরির জন্য অযোগ্য। আর যদি সিভিটি আপনি নিজেই তৈরি করে থাকেন, তাহলে সেখানে কী আছে তা আপনার জানা থাকার কথা। বেশিরভাগ ইন্টারভিউতে প্রাথমিক পর্যায়ে সিভি থেকেই প্রশ্ন করা হয়। সুতরাং, সিভিতে যা যা লিখেছেন, তা আবার একবার দেখে নিন, এতে উত্তর দিতে সুবিধা হবে। আপনার উচ্চারণ গড়পড়তা মানের হলেও, মনে রাখবেন, স্পিকিংয়ের ক্ষেত্রে বাক্যগঠনে দক্ষতা থাকা জরুরি। এই ছোট দক্ষতাটুকু আপনার অবশ্যই থাকতে হবে। বিশ্বাস রাখুন, একটু অনুশীলন করলেই এটি আয়ত্ত করতে পারবেন। যদি তবুও সমস্যা হয়, অনেক প্রতিষ্ঠানই স্পোকেন ইংলিশের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে; আজই সেখানে ভর্তি হয়ে যান। নিজেকে প্রস্তুত করুন, কোনো অজুহাত চলবে না।
মনে রাখতে হবে, চাকরি আপনাকে অর্জন করে নিতে হবে। এমন হতে পারে, নিয়োগকর্তা একের পর এক প্রশ্ন করে আপনাকে জর্জরিত করছেন, আর আপনার মনে হচ্ছে, এই বুঝি চাকরিটা হলো না। ঠিক যে মুহূর্তে এই চিন্তা আপনার মনে আসবে, আপনার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ কমে যাবে। নিজের প্রতি আস্থা রেখে নিজেকে উপস্থাপন করুন। একটি ছোট দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে যান (যার সঙ্গে তার আগে কখনো দেখা হয়নি), তিনিও কিছুটা নার্ভাস হন। তাই বলে কি তিনি হাল ছেড়ে দেন? হয়তো তিনি দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে কথা বলতে গেছেন, আর সারাদেশের মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক্ষেত্রে এই নার্ভাস অবস্থায়ও কিন্তু তিনি কাজ হাসিল করে নিয়ে আসবেন। চাকরিপ্রার্থীকেও ভাবতে হবে: চাকরিটা দরকার, হয়তো পরিবার তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাই নার্ভাস লাগলেও সামনে বসা মানুষগুলোকে তা বুঝতে দেওয়া যাবে না। নিশ্চয়ই আপনি জয়ী হবেন। একবার ভেবে দেখুন, এই চাকরিটা যদি না হয়, তাহলে যারা আপনার সামনে আছেন, তাদের সঙ্গে কি আপনার আবার দেখা হবে, নাকি তারা সব ইন্টারভিউ বোর্ডে থাকবেন? যদি তা না হয়, তবে কিসের ভয় – চাকরি আজ না হয় কাল হবে। ইন্টারভিউ বোর্ডে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, আপনি যা বোঝাতে চাইছেন তা যেন সামনের মানুষগুলো বোঝেন, আর নিয়ন্ত্রণ যেন আপনার হাতে থাকে। নিজেকে উপস্থাপন করুন, আপনি যেমন ঠিক সেভাবে। ধরা যাক, প্রার্থী একটি প্রশ্নের উত্তর জানেন না, অথচ লটারির মতো ধারণা করে একটি উত্তর দিয়ে দিলেন; এটা ভালো নয়। নিজের প্রতি সৎ থাকুন, পরে আফসোস করতে হবে না। সবাইকে সবকিছু জানতে হবে বা সবাই সবকিছু জানে – এটি ঠিক নয়। যা জানেন না, সেক্ষেত্রে সরাসরি ‘না’ বলুন। বেশি স্মার্ট হতে গেলে আরও বিপদে পড়বেন, কারণ সামনে অভিজ্ঞ কিছু মানুষ আছেন। তারা বহু আগে আপনার অবস্থানে ছিলেন, আজ তারা অভিজ্ঞ। তাই তারা অপছন্দ করবেন এমন কিছু করবেন না। গ্রীষ্মকালে প্রখর রোদে স্যুট-বুট পরে ঘেমে-নেয়ে ইন্টারভিউ বোর্ডে গেলেন, আর প্রার্থীর গা দিয়ে দরদর করে ঘাম পড়ছে, এমনকি এসি রুমেও! তখন নিয়োগকর্তারা কী ভাববেন? তারা কি ভাববেন আপনি অনেক স্মার্ট? যদি রাকিব সাহেবের মতো লোক থাকেন, তিনি প্রথমেই আপনাকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘কোন বাহনে ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন?’ আপনি উত্তর দেবেন, সিএনজিচালিত থ্রি-হুইলার কিংবা লোকাল বাস! সেক্ষেত্রে তিনি ভেবে নেবেন, আপনার কমন সেন্সের অভাব আছে। ওই যে আগে বলেছি, বেশি স্মার্ট হলে বিপদে পড়বেন! নিজেকে পরিপাটি করে সাজানো মানে আপনার যা আছে, সেটিকেই সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হবে। চুল যেন এলোমেলো না থাকে, জুতায় যেন কাদা লেগে না থাকে, শার্ট যেন ইন করা থাকে। তাই বলে এই নয় যে, অনেক দামি পোশাক পরে আসতে হবে। তারা শুধু দেখবেন, প্রার্থীর পরিহিত পোশাক-পরিচ্ছদ পরিষ্কার আছে কি না, আর প্রার্থী আত্মসচেতন কি না।
চাকরিপ্রার্থীকে মনে রাখতে হবে, সামনে যারা আছেন তারাও মানুষ। বর্ষাকালে আপনার নিজের গাড়ি নেই, সুতরাং গণপরিবহনে যাতায়াত করবেন। সেজন্য কিছুদূর পথ হাঁটবেন, তা তারাও বুঝতে পারেন। সেক্ষেত্রে জুতোর এক কোণে একটু কাদা লেগে থাকলে মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু প্রখর রোদে এমন অবস্থা থাকলে তারা মেনে নেবেন না। প্রথম ইমপ্রেশনটাকে স্মরণীয় করুন, আর অজুহাত থেকে দূরে থাকুন, হতাশাকে দূরে ছুড়ে ফেলুন। আপনাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি আপনার অন্নের কথা ঠিকই চিন্তা করেছেন। কিন্তু তা অর্জন করতে হলে আপনার প্রচেষ্টা, সদিচ্ছা ও পজিটিভনেস খুবই জরুরি বিষয়।
তৌহিদুল ইসলাম চঞ্চল
কলামিস্ট, মানবসম্পদ- শ্রম ও মানবাধিকার প্রশিক্ষক
মতামত লিখুন :