আব্দুল আলিম: কয়েক বিলিয়ন ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিলের খবরে আমরা অনেক হতাশ হয়েছিলাম। কিছু ক্রেতা দায়িত্বহীন আচরন করেছেন। মুহুর্তের মধ্যে ক্রয়াদেশ বাতিলের নোটিশ পাঠিয়েছেন। এমনকি এমন ক্রেতাও আছেন বানানো পোশাক নিবেন না বলে জানাচ্ছেন। এটা চরম অন্যায়। এটা আমাদের মানতে হবে যে যাদের স্টোর বন্ধ তাদের এখন এই পোশাক নিয়ে বিক্রি বা ডিসপ্লে কারার কোন সু্যোগ নাই। তারপরও কেনা পোশাক আপনি বাতিল করতে পারেন না। তবে ক্রেতাদের অনেকেই দায়িত্বশীল আচরন করছেন।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্যাকেজ কে সাগত জানিয়েছেন বিজিএমইএ। তার মানে হল, এখন তারা অনেকটা চিন্তামুক্ত হয়েছেন। বড় ক্ষতির কিছুটা পুষিয়ে যাবে।
জরুরি তহবিল ঘোষণার পরও যখন কারখানা খোলা রাখা জরুরি তখন আমরা কি এটা মনে করতে পারি না যে, আপনাদের হাতে যথেষ্ট কাজ আছে? যাদের কাজ নেই তারা অনেকেই তহবিল ঘোষণা শুনার আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছেন, পরেও অনেকেই ছুটি দিয়েছেন। সরকার ঘোষিত সহায়তা তাহলে ওই কারখানাগুলির পাওয়া উচিত। যাদের কাজ আছে তারা তো টাকা পাবেন, পাচ্ছেন, তাই তাদের ব্যবসা সাভাবিক।
যদি আপনার হাতে যথেষ্ট কাজ থাকে তাহলে আপনার কোন মাসের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। বানানো পোশাক যদি না নেয় তাহলে আমরা এখন কারখানায় কি বানাচ্ছি? আমি আসলে অবস্থাটা বুঝার চেষ্টা করছি।
এবার আসি সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে। সারা পৃথিবী যখন একটা ভয়াবহ মহামারির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তখন আমি আপনি কেউ কি অর্থনৈতিক ক্ষতির বাইরে আছি? রিক্সাচালক থেকে শুরু করে শিল্পপতি, কেউ কি এই ভয়াবহতার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত? উত্তর নিশ্চয়ই না হবে। তাহলে পোশাক খাতের বিনিয়োগকারিরাও তো এই ক্ষতির সম্মুখীন হবেন, এটাই সাভাবিক। তবে পোশাক খাত আমাদের অর্থনীতির অক্সিজেন। আমাদের যাদের পোশাক কারখানা নেই, তারাও তো এই পোশাক খাতের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। আমরা সবাই চাই এই পোশাক খাতকে বাচাতে। তার প্রমানও ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। সহায়তা নিয়ে পাশে দাড়িয়েছেন। মালিকগন ধন্যবাদও জানিয়েছেন। তার মানে হল, পোশাক মালিকদের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে কিছুটা আশা জাগিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর আপৎকালীন তহবিল কিন্তু পুরো ক্ষতি পোষানোর প্যাকেজ না। এটা তাৎক্ষণিক বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য। বিশেষ করে শ্রমিকের বেতন নিয়ে কোন সমস্যা না হয়।
এবার একটু গল্প বলি, আমাদের কেউ যখন খুব দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হন, তখন আমাদের সর্বস্ব দিয়ে আমরা শুধু বাচিয়ে রাখতে চাই। জানি যে সে আর আগের মত হবেনা। কোথাও দুর্ভিক্ষ হলে, নিশ্চই কেউ মাছ মাংস খুজবেনা। কোন রকম বেচে থাকার জন্য যা দরকার তাই হলেই খুশি হবেন। কিন্তু পোশাক খাত বাচাতে রাষ্ট্র এগিয়ে আসার পর এখন দেখছি ভিন্ন কিছু। আমাদের পোশাক কারখানা কি পুরো ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা বা ক্ষতি পুষিয়ে লাভ বা বেশি লাভের আশা করছি? কেন করবো না? অন্যরা যখন সাপ্লাই দিতে পারছেনা তখন সুযোগটা আমরা কেন নিবোনা? অবশ্যই নিবো। পোশাক খাত বেশি উৎপাদন করে বেশি রপ্তানি করলে তো দেশের লাভ, দেশের লাভ হলে আমারও লাভ। কিন্তু আমার প্রশ্ন ভিন্ন জায়গায়।
বাংলাদেশ যে এই বিশ্ব মহামারির বাইরে না সেটার জন্য নিশ্চয়ই আমাকে ব্যাখ্যা দিতে হবেনা। সরকারি, বেসরকারি সকল অফিস আদালত বন্ধ। সারা দেশে হাট-বাজার-চায়ের দোকানে ভিড় না করার নির্দেশ এসেছে। প্রয়োজন ছাড়া ঘরে থাকার নির্দেশ এসেছে। মহামারি মোকাবেলায় সশস্ত্র বাহিনি মাঠে নামিয়েছেন সরকার। তার মানে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিস্থিতে পোশাক কারখানায় কর্মরত ৪০ লক্ষাধিক শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ঝুঁকিতে ঠেলে দিয়ে আমরা কি অর্জন করতে চাচ্ছি?
অর্থনৈতিক সহায়তা ঘোষণার পর আমরা আশা করেছিলাম, এবার কারখানা বন্ধের ঘোষণা আসবে। কিন্তু এখনও আসেনি। ঘোষণা আসার আশা এখনও শেষ হয়নি তবে শ্রমঘন এই খাত সংশ্লিষ্ট সকল শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীগন ও তাদের পরিবার বিরাট উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। স্পষ্টভাবে তারা করোনা ভাইরাসে সর্বোচ্চ ঝুকিতে আছেন। অনেক কারখানা কিছু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, যার বেশি পদক্ষেপ আসলে বাস্তবে সম্ভবও না। সম্ভব সর্বোচ্চ সাবধানতার পরেও করোনা ঝুকির মাত্রা শ্রমঘন এই খাতে অনেক বেশি।
সাস্থ্য ঝুকির বাইরেও বড় একটা সম্ভাব্য ঝুকি সৃষ্টি হচ্ছে। সেটা হল আস্থার ঝুঁকি। এক দিকে দেশের সকল নাগরিককে ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়ে, সেটা নিশ্চিত করতে সশস্ত্র বাহিনি, পুলিশ মাঠে নামিয়েছি ঠিক একই সময় ৪০ লক্ষ মানুষের ঝুকি আমরা দেখেও দেখছিনা। শুধুই অর্থনৈতিক কারনে। এতে করে শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীগন ও তাদের পরিবার এই চাকরির ওপর স্থায়ীভাবে আস্থা হারাবে। শুধু আমাদের অর্থনীতি বাচাতে আমরা তাদের কোথায় ঠেলে দিতে পারি সেটা তারা জেনে যাচ্ছে। আজকের পোশাক শিল্প শুধু বিনিয়োগের মাধ্যমে এখানে এসে দাড়ায়নি। সংশ্লিষ্ট সকলের কঠোর শ্রম ও ভালোবাসার ফসল আজকের সফলতা। আগামীদিনের চেলেঞ্জ মোকাবেলায় সকলের কঠোর শ্রম দিতে হবে, আস্থাহীনতা তখন বাধা হয়ে দাড়াতে পারে। আগামী প্রজন্ম যা দেখছে তাতে এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে।
মানুষের জন্য অর্থ নাকি অর্থের জন্য মানুষ? মানুষ বাচানোর আকুতিতে সারা দুনিয়া যখন কার্যত অচল, তখন এই পোশাক খাতে কর্মরত ভাই-বোনদের আলাদা জাতে ফেলবেন না। যারা ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন, তারা বাসায় বসে অফিস করছে, আমরা বিভিন্নভাবে এই খাতের সাথে জড়িতরাও বাসায় বসে কাজ করছি। পোশাক খাতের কর্মরত শ্রমিক কর্মকর্তাদের উৎকন্ঠা আমাদের মত ঘরে বসা মানুষদের সার্থপরতার গ্লানিতে নিমজ্জিত করছে।
যারা দিনকে রাত, রাতকে দিন করে এই খাতের জন্য শ্রম দিচ্ছেন, যারা মালিকের বিনিয়োগের অতন্ত্র প্রহরি, তাদের করোনা ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকার জন্য বাসায় থাকার সুযোগ দিতে প্রয়োজন হলে আরও তহবিল ঘোষনা করুন। প্রয়োজনীয় সকল সচেতনতা প্রদান করে, সকল যান-চলাচল বন্ধ করে,ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়ে পোশাক কারখানাগুলি সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করুন। বেচে থাকলে এই শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীগন আরো বেশি শ্রম দিয়ে আমাদের ক্ষতি নিশ্চয়ই পুষিয়ে দিবেন। এ প্রমান আমরা আগেও রেখেছি।
সচেতন থাকুন, নিরাপদে থাকুন, নিরাপদে রাখুন।
লেখক: সম্পাদক, দি আরএমজি টাইমস
মতামত লিখুন :