ড. উত্তম কুমার দাস : পত্রিকান্তরে খবর বেরিয়েছে, এক বহুজাতিক কোম্পানির-অংশীদার প্রতিষ্ঠান তার পাঁচ শ’র বেশী কর্মীকে ‘টার্মিনেট’ করছে। এর প্রেক্ষিতে আমার অনেক ফেসবুক-বন্ধু জানতে চেয়েছেন, কোন শ্রমিক বা কর্মীকে টার্মিনেশন হলে তার আইনি-প্রতিকার কি? টার্মিনেট হওয়া ব্যক্তির পাওনাই বা কি? বিষয়টি নিয়ে আমরা আগে লিখলেও এর গুরুত্ব বিবেচনায় আবার লিখছি।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (২০১৩ সনের সংশোধনীসহ)- এর ধারা ২৬ কোন মালিক বা নিয়োগকর্তাকে তার অধীন কর্মরত শ্রমিক (বা কর্মীকে) টার্মিনেট করার সুযোগ দিয়েছে।
তবে টার্মিনেশন কোন শ্রমিক বা কর্মীর কোন দোষের কারণে নয়; বরং সংশ্লিষ্টও নিয়োগকর্তা তার সুবিধায় তা করেন। তাই এইক্ষেত্রে দোষারোপ করা যাবেনা; উচ্চ আদালত বিভিন্ন মামলার রায়ে এমন রায় দিয়েছেন।
শ্রম আইনের ২(৬৫) ধারা অনুসারে, কারিগরি ও ব্যবসা উন্নয়নমূলক প্রভৃতি কাজে নিয়োজিতরাও শ্রমিক সংজ্ঞার আওতায় পড়বেন। কেউ শ্রমিক সংজ্ঞার আওতায় পড়বে কি পড়বে না তা নিয়ে মতান্তর হলে শ্রম আইনের ২১৩ ধারার আওতায় শ্রম আদালতে প্রতিকার চাওয়া যাবে।
এবার আসা যাক কাউকে তার চাকরি থেকে টার্মিনেট করলে পাওনাদি কি কি। এই গুলি হল (স্থায়ী শ্রমিক বা কর্মী হলে)-
১। ১২০ দিনের নোটিশ (বা তার বদলে মজুরী; এইক্ষেত্রে মূল-মুজরীর সমপরিমাণ)। কাউকে ১৮ জুলাই টার্মিনেশন-নোটিশ দিলে ১৯ নভেম্বর ১২০ দিন পূর্ণ হবে।
২। টার্মিনেশন করা ব্যক্তির প্রতি বছর চাকরীর জন্য ৩০ দিন হারে মজুরী, বা গ্রাচুইটি যা বেশী হবে তা। অর্থাৎ ১০ বছর চাকরী হলে ৩০ দিনের মজুরী x ১০ হবে। কোন প্রতিষ্ঠানে পূর্ববর্তী ১২ মাসে অন্ততঃ ২৪০ দিন কাজ করলেই এক বছর ধরা হবে। আর মজুরীর হিসাব হবে- টার্মিনেশনের অব্যবহিত আগের ১২ মাসের পাওয়া মূল-মুজরী এবং মহার্ঘ ভাতা এবং এডহক বা অন্তর্বর্তী মুজুরী (যদি থেকে) তার গড়।
৩। বকেয়া মজুরী।
৪। ছুটি, বন্ধ, অথবা ওভারটাইমের জন্য কোন পাওনা।
৫। অর্জিত ছুটি ভোগ না করে থাকলে তার বাবদ পাওনা।
৬। নিয়োগের শর্ত মোতাবেক বোনাস বা অন্য কোন পাওনা।
৭। ভবিষ্যৎ তহবিল থাকলে তার পাওনা।
৮। লভ্যাংশ থেকে পাওনা।
টার্মিনেট করা শ্রমিক (বা কর্মীকে) তার সার্ভিস বই (যদি থাকে) ফেরত এবং চাকরী-সংক্রান্ত সনদপত্র দিতে হবে (ধারা ৩১)।
কত দিনের মধ্যে পাওনাদি দিতে হবে?
শ্রম আইনের ৩০ ধারা অনুযায়ী, চাকরী অবসানের পরবর্তী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রাপ্য সকল পাওনা নিয়োগকারীকে পরিশোধ করতে হবে।
মজুরী ও পাওনাদি যথাসময়ে না পেলে?
পাওনাদি সম্পর্কে অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক তা জানার ৩০ দিনের মধ্যে তার নিয়োগকারীর কাছে লিখিত আকারে অভিযোগ করতে পারবেন। এইক্ষেত্রে সমাধানের সময়সীমা ৩০ দিন; ব্যর্থতায় ৩০ দিনের মধ্যে শ্রম আদালতে প্রতিকার চাওয়া যাবে (ধারা ৩৩)।
মুজরীসহ অন্যান্য পাওনাদি “আপোষ-মীমাংসার” জন্য আদায়ের করতে কল কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন দপ্তরে আবেদন করা যাবে [ধারা ১২৪)ক)]।
আইন অমান্য করে কোন নিয়োগকর্তা মজুরীসহ পাওনাদি পরিশোধ না করলে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক শ্রম আইনের বিধান মোতাবেক শ্রম আদালতে আবেদন (মামলা) করতে পারবেন (ধারা ১৩২)।
পাওনাদারের মৃত্যু হলে তার উত্তরাধিকারী বা আইনসঙ্গত প্রতিনিধি এই মামলা করতে পারবে। পাওনার তারিখ থেকে ১২ মাসের মধ্যে তা করতে হবে। এই ক্ষেত্রে পনার উপর ২৫% ক্ষতিপূরণ চাওয়া যাবে।
পরিশোধের দায় কার?
প্রতিষ্ঠানের মালিক বা তার পক্ষে নিযুক্ত কেউ মজুরী ও পাওনাদি পরিশোধের জন্য দায়ী। যেমন- প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপক অথবা তত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের জনে প্রতিষ্ঠানের-মালিকের কাছে দায়ী কোন ব্যক্তি (ধারা ১২১)।
ব্যর্থতায় প্রতিষ্ঠানের মালিক বা মজুরী পরিশোধের জন্য দায়ী ব্যক্তির সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট আদালত (শ্রম আদালত বা শ্রম আপীলেট ট্রাইব্যুনাল) ক্রোক করার আদেশ দিতে পারবেন (ধারা ১৩৬)। তবে পাওনাদি পরিশোধের চূড়ান্ত দায় প্রতিষ্ঠান-মালিকের (ধারা ১৩৭)।
ব্যর্থতায় মালিক তথা নিয়োগকারীর জেল ও জরিমানা হতে পারে (ধারা ২৮৩ ও ৩০৭)।
লেখক : এলএল.এম. (যুক্তরাষ্ট্র), পিএইচ.ডি. (আইন)
এডভোকেট, সুপ্রীম কোর্ট অব বাংলাদেশ
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ ০১৭৫৬ ৮৬৬৮১০।
মতামত লিখুন :