ড. উত্তম কুমার দাস: বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ কাদের জন্য প্রযোজ্য তা উক্ত আইনের প্রথম অধ্যায়ে বিস্তৃতভাবে বলা হয়েছে। তবে মোটাদাগে বলা যায় বলা যায়- দেশের শিল্প-কারখানা, প্রতিষ্ঠান (ব্যাংক, বীমাসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান) প্রভৃতির জন্যে উক্ত আইন প্রযোজ্য। [সরকারী প্রতিষ্ঠানের জন্যে সরকারী চাকরী বিধিমালা প্রযোজ্য; তবে কতিপয় ব্যতিক্রমবাদে তাঁদের দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার ও শিল্প-বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে শ্রম আইন প্রয়োগ হবে।]
বাংলাদেশ শ্রম আইন মোটা দাগে দু’পক্ষের জন্যেঃ মালিক এবং শ্রমিক।
শ্রমিক অর্থ শিক্ষাধীনসহ কোন ব্যক্তি, তার চাকরীর শর্তাবলী প্রকাশ্য বা উহ্য যেভাবেই থাকুক না কেন, যিনি কোন প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরিভাবে বা কোন ঠিকাদার যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, এর মাধ্যমে মজুরী বা অর্থের বিনিময়ে কোন দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরানীগিরির কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন, কিন্তু প্রধানতঃ প্রশাসনিক, তদারকি কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি এর অন্তর্ভুক্ত হবেনা।
তবে এটা সরল সংজ্ঞা। এতে অনেক ব্যতিক্রম রয়েছে।
আইনে “মালিক”- এর যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তাতে “এমন কোন ব্যক্তি যিনি প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক নিয়োগ করেন” তিনিসহ “নিয়ন্ত্রণকারী চূড়ান্ত ব্যক্তি অথবা ব্যবস্থাপক অথবা উক্ত কাজ-কর্মের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কোন উপযুক্ত কর্মকর্তা” এরা সবাই অন্তর্ভুক্ত। [শ্রম আইন, ধারা ২(৪৯)]
তো এমন কোন কর্মকর্তা বে-আইনীভাবে চাকরী হারালে করনীয় কি? সেটাই এই লেখার আলোচ্য বিষয়।
যে যে ভাবে কারও চাকরীতে বিরতি কিংবা চাকরী যেতে পারে তা হলঃ লে-অফ, ছাঁটাই, ডিসচার্জ, বরখাস্ত, টার্মিনেশন বা অপসারণ ইত্যাদি।
তবে এইগুলোর আইনী প্রক্রিয়া এবং ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। যা পদত্যাগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই ক্ষেত্রে ব্যত্যয় হলে তার প্রতিকার খুঁজতে হবে।
এই ক্ষেত্রে প্রথমে যাচাই করতে হবে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি “শ্রমিক”- এর সংজ্ঞার আওতায় না বাইরে।
বাইরে হলে (অর্থাৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী হলে) তাঁর পাওনাদি ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্যে প্রথমে সংশ্লিষ্ট মালিক/নিয়োগকারী অর্থাৎ তাঁর পক্ষে দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে যাওয়া দরকার। চাকরী অবসানের দিন থেকে (ছাঁটাই, ডিসচার্জ, অপসারণ ইত্যাদি) ৩০ কর্ম-দিবসের মধ্যে এই পাওনাদি পরিশোধ করতে মালিক বাধ্য [শ্রম আইন, ধারা ১২৩(২)]
আমাদের এখানকার যে প্রবণতা তাতে দেখা যায়, কর্মকর্তারা মূলতঃ বেআইনীভাবে বরখাস্ত বা টার্মিনেটের শিকার বেশী হন।
কাউকে টার্মিনেট হলে প্রাপ্য হবেঃ (১) বকেয়া মজুরী, (২) ছুটি, বন্ধ অথবা ওভারটাইমের জন্য প্রাপ্য পারশ্রিমিক, (৩) নিয়োগের শর্ত মোতাবেক প্রদেয় কোন বোনাস, (৪) অভোগকৃত অর্জিত ছুটির টাকা (মোট মজুরীর ভিত্তিতে), (৫) নোটিশ না দিলে ১২০ দিনের মজুরী (মূল মজুরী), (৬) স্থায়ী শ্রমিক হলে প্রত্যেক সম্পূর্ণ বছর চাকরীর জন্যে ৩০ দিনের মজুরী হারে ক্ষতিপূরণ (মূল মজুরী) বা গ্রাচুইটি যা বেশী হবে; (৭) ভবিষ্যৎ তহবিল থেকে পাওনা, যদি থাকে। (এখানে একটি উদাহরণ দেওয়া হল)।
উক্ত পাওনাদি না পেলে অর্থাৎ মালিক তা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে চাকরী হারানো কর্মকর্তা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।
এই ক্ষেত্রেঃ
(১) চাকরীবলে স্বীকৃত তাঁর অধিকার প্রয়োগ তথা পাওনা আদায়ের জন্যে শ্রম আদালতে দরখাস্ত (মামলা) করতে পারেন। [শ্রম আইন, ধারা ২১৩];
(২) বে-আইনীভাবে বরখাস্ত হলে দেওয়ানী আদালতেও যাওয়া যেতে হবে। পাওনার পরিমাণ দু’লাখ টাকার মধ্যে হলে সংশ্লিষ্ট সহকারী জজ আদালতে (যে এলাকায় আপনার প্রতিষ্ঠান তার ভিত্তিতে) যাওয়া। দাবীর পরিমাণ দু’ লাখ টাকার বেশী তবে চার লাখ টাকার মধ্যে হলে সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে যেতে হবে। তার বেশী হলে যেতে হবে যুগ্ম জেলা জজ আদালতে। [সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, ১৮৭৭, ধারা ৪২]।
আমাদের এখানে প্রবণতা হল- বে-আইনী চাকরীচ্যুতির শিকার হলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আইনী প্রতিকার পেতে তৎপর হননা। এর কারণ হল- তাঁর নিজ অধিকার ও প্রতিকারের পথ সম্পর্কে অজ্ঞতা। একই অজ্ঞতা (না জানা) সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী এবং পরামর্শ ও সহায়তা-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। রয়েছে এই বিষয়ে অভিজ্ঞ ও দক্ষ আইনজীবীর অভাব। ক্ষতিগ্রস্থদের অনেকে ভাবেন প্রতিকার পেতে গেলে তা জানা-জানি হবে, যা তাঁর পরবর্তীতে কোন চাকরী পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হতে পারে।
এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হল- কেউ অন্যায় পদক্ষেপের শিকার হলে তার প্রতিবাদ ও প্রতিকার খোঁজা উচিত। যা অধিকারও বটে। এতে খতিগ্রস্থ ব্যক্তি যেমন ক্ষতিপূরণ পেতে সক্ষম হবেন, তেমনি আইন ভঙ্গকারীরাও শাস্তি পাবে কিংবা ভবিষ্যতের জন্য পাবে সতর্ক বার্তা।
পরামর্শ ও বিশ্লেষণঃ ড. উত্তম কুমার দাস, এলএল.এম. (যুক্তরাষ্ট্র), পিএইচ.ডি. (আইন), এডভোকেট, সুপ্রীম কোর্ট অব বাংলাদেশ; শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ। ই-মেইলঃ [email protected]
মতামত লিখুন :