ভূমিকা:
২৪ এপ্রিল, ২০১৩- সকালটা ছিল আর দশটা দিনের মতোই। কিন্তু সাভারের রানা প্লাজার নিচে যেসব শ্রমিক জীবনের লড়াইয়ে কাজে এসেছিলেন, তাদের জন্য দিনটা পরিণত হয় ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নে। এক মুহূর্তেই ধসে পড়ে ভবনটি। চিৎকার, কান্না, ধ্বংসস্তূপ আর রক্তের মাঝে হারিয়ে যায় হাজারও জীবন। যারা বেঁচে ছিলেন, তাদের অনেকেই আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন পঙ্গুত্ব, ক্ষত, আর মানসিক যন্ত্রণা।
এই ধস কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল না; ছিল এক নির্মম, প্রতিরোধযোগ্য, মানুষসৃষ্ট বিপর্যয়। বারবার ফাটলের অভিযোগ আসার পরও কেন শ্রমিকদের জোর করে ঢুকতে বাধ্য করা হলো? কেন নিরাপত্তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেল উৎপাদন? রানা প্লাজা যেন ছিল মুনাফার লোভে গড়ে ওঠা এক ‘মৃত্যুকূপ’ যেখানে মানুষ ছিল কেবল উৎপাদনের যন্ত্র, যার বিকল হওয়া মানে কেবল এক পরিসংখ্যানে রূপ নেয়া।
আজ এক যুগ কেটে গেছে। সময় বদলেছে, পোশাক রপ্তানি বেড়েছে, ভবনের গায়ে সেফটি ট্যাগ লেগেছে কিন্তু কি সত্যিই ক্ষতিপূরণ হয়েছে সেই হাজারো অদৃশ্য চোখের জল, প্রতিবন্ধী জীবন আর অনাহারে বড় হওয়া শিশুদের?
এই প্রবন্ধে আমরা ফিরে তাকাব রানা প্লাজার সেই ভয়াল ক্ষতির দিকে, খতিয়ে দেখব এক যুগের ব্যবধানে আমরা কী শিখেছি, আর কী বাকি রয়ে গেছে। কারণ কিছু ক্ষতি শুধু ক্ষতিপূরণের অঙ্কে মাপা যায় না; কিছু ক্ষত ইতিহাস হয়ে যায়।
রানা প্লাজার ধসের পেছনে মূল দোষীদের চিহ্নিত করলে কয়েকটি স্তর পাওয়া যায় — প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ এবং গোপনভাবে দায়ী পক্ষ। বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায়:
রানা প্লাজার ধস কোনো একটি ব্যক্তির ভুল ছিল না, এটি ছিল একাধিক পক্ষের অপরাধ, অবহেলা ও দুর্নীতির সম্মিলিত ফলাফল। প্রথমত, ভবন মালিক সোহেল রানা ছিলেন সরাসরি দায়ী। তিনি অবৈধভাবে অনুমোদিত নকশা অমান্য করে আটতলা বিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করেন, যেখানে ছিল মারাত্মক গলদ। ফাটল দেখা দেওয়ার পরও শ্রমিকদের কাজে ঢুকতে জোর করে বাধ্য করা হয়, যা একটি সুস্পষ্ট অপরাধ।
নির্মাণ কাজে জড়িত প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররাও কম দায়ী নন। তারা দুর্বল নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে ভবনটি নির্মাণ করেন, যা ভারী মেশিনের কম্পন সহ্য করার মতো সক্ষম ছিল না। অথচ ভবনটিতে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি চালু হয়, যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করতেন।
আরেকটি বড় দায় বর্তায় কারখানার মালিক ও ব্যবস্থাপকদের ওপর। তারা শ্রমিকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা না করে, উল্টো চাকরি হারানোর ভয় দেখিয়ে বিপজ্জনক অবস্থায়ও কাজে পাঠান। এ ধরনের মানসিক চাপ ও অনৈতিক নির্দেশ শ্রমিকদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
স্থানীয় প্রশাসন এবং সরকারি সংস্থার ব্যর্থতাও কম গুরুতর নয়। যথাযথ তদারকি, নির্মাণ অনুমতি যাচাই কিংবা নিরাপত্তা ঝুঁকির পর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং রাজনৈতিক আশ্রয় এবং প্রভাব কাজে লাগিয়ে ভবন নির্মাণ ও পরিচালনা বৈধতার চাদরে ঢেকে রাখা হয়। সোহেল রানা ছিলেন স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তি, যার জন্য অনেক অনিয়ম ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব হয়।
আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও ক্রেতারাও দায় এড়াতে পারে না। তারা অত্যন্ত কম দামে দ্রুত পণ্য সরবরাহের চাপ সৃষ্টি করেছিল, যার ফলে স্থানীয় কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের নিরাপত্তার পরিবর্তে উৎপাদন বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেন।
রানা প্লাজার ধসের মতো মর্মান্তিক ঘটনায় দেশের সরকারও দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, শিল্পকারখানার সঠিক অনুমোদন ও তদারকি করা, এবং যে কোনো ঝুঁকি মোকাবেলায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, প্রশাসনিক দুর্বলতা, অনিয়ম এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সেই দায়িত্ব পালনে বড় ধরনের ব্যর্থতা ঘটেছে।
ভবন নির্মাণের সময় অনুমোদন ও নকশা যাচাইয়ের নিয়মনীতি পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছিল। ফাটল ধরার একদিন পরই ভবনটি ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দিতে পারতো স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু তা হয়নি। বরং ভবনের মালিক সোহেল রানা স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সব কিছু চালিয়ে যান, যা প্রকাশ করে দেয় সরকারী তদারকির কী ভয়াবহ ব্যর্থতা ছিল।
এছাড়া, শ্রম মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বিভিন্ন সংস্থা যারা শ্রমিক নিরাপত্তা ও কারখানা পরিদর্শনের দায়িত্বে ছিল তারাও সময়মতো কার্যকরী ভূমিকা নেয়নি। দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু কর্মকর্তা হয়তো অন্ধ দৃষ্টিতে সব কিছু পাশ করিয়ে দিয়েছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে হাজারো প্রাণ ঝরে গেল।
রানা প্লাজার ধসের পর সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে ঠিকই কিন্তু সেগুলো অনেকাংশে “ঘটনার পরে” নেওয়া পদক্ষেপ। ঘটনার আগে সঠিক নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি থাকলে হয়তো এত বড় বিপর্যয় ঘটতো না।
সুতরাং, বলা যায়, রানা প্লাজার মতো ট্র্যাজেডিতে সরকারের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। অবহেলা, দুর্বল নীতিমালা প্রয়োগ, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব সব মিলিয়ে সরকার নিজেও এই ট্র্যাজেডির একটি বড় অংশীদার হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাজারো পরিবারের কান্না, হারিয়ে যাওয়া ভবিষ্যত আর থেমে যাওয়া জীবন- এর জন্য রাষ্ট্রকেও জবাবদিহি করতে হবে ইতিহাসের কাছে।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় জড়িত বায়াররা ও তাদের পরবর্তী ভূমিকা:
রানা প্লাজার ভেতরে থাকা কারখানাগুলোর সাথে বিশ্বের বেশ কয়েকটি বড় ব্র্যান্ড যুক্ত ছিল।
দুর্ঘটনার পরে কিছু বায়ার মানবিক দিক থেকে বেশ দ্রুত এগিয়ে আসে। তারা রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য জরুরি খাদ্য সহায়তা ও নগদ ক্ষতিপূরণ প্রদান করে এবং দীর্ঘমেয়াদে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। আবার কেউ প্রথমদিকে কিছুটা অস্বীকারের চেষ্টা করলেও পরবর্তীতে তারা ক্ষতিপূরণ তহবিলে অবদান রাখে, অর্থসাহায্য প্রদান করে, যদিও তাদের ভূমিকা নিয়ে নানাভাবে সমালোচনা হয়েছে। বিশেষ করে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এবং দেরিতে সহায়তার জন্য।
অনেকে দাবি করেন, কিছু বায়ার শুরুতে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ, শ্রমিক সংগঠনগুলোর প্রচার এবং ক্রেতাদের বয়কটের হুমকিতে পড়ে তারা শেষমেশ ক্ষতিপূরণ তহবিলে অবদান রাখে। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়- শুধু আর্থিক সহায়তা দিয়ে কি শ্রমিকদের হারানো জীবন এবং ভেঙে পড়া ভবিষ্যত ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব?
কিছু বড় বড় ব্র্যান্ডের ভূমিকা নিয়ে প্রবল বিতর্ক ছিল। তারা সরাসরি তহবিলে বড় অবদান না রাখার কারণে মানবিক দায়বদ্ধতা প্রশ্নের মুখে পড়ে। যদিও পরে তারা আলাদা কিছু সেফটি প্রোগ্রাম চালু করে।
সুতরাং বলা যায়, কিছু বায়ারের ভূমিকা মানবিক ছিল, আবার কিছু বায়ার বাধ্য হয়ে ন্যূনতম মানবিক সহায়তা প্রদান করেছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের চাপ না থাকলে হয়তো এতটুকু প্রতিক্রিয়াও দেখা যেত না।
এঘটনায় জড়িতদের বর্তমান কে কোথায় আছেন?
রানা প্লাজা ধসের এক যুগ পরেও এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়নি। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে আটতলা রানা প্লাজা ভবন ধসে পড়ে, যাতে ১,১৩৪ জন শ্রমিক প্রাণ হারান এবং প্রায় ২,৫০০ জন আহত হন ।
ভবনটির মালিক সোহেল রানাসহ মোট ৪১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৫ সালের ২৪ মে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর এই মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন ।
২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সোহেল রানাকে দুর্নীতির মামলায় তিন বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০,০০০ টাকা জরিমানা করা হয় ।
বর্তমানে সোহেল রানা কারাগারে আছেন, তবে অন্যান্য অভিযুক্তদের মধ্যে ৩১ জন জামিনে মুক্ত, ৬ জন পলাতক এবং ৩ জন মারা গেছেন ।
এই দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া এবং দেরিতে বিচারপ্রাপ্তি শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা ও গাফিলতির প্রতিফলন।
তৎকালীন সময়ের নেয়া পদক্ষেপ সমুহঃ
রানা প্লাজার ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে এক বিরাট অঙ্গীকার করা হয়েছিল — শ্রমিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, ন্যায্য ক্ষতিপূরণ, এবং ভবনগুলোর অবকাঠামোগত সংস্কার। সে লক্ষ্যে নেওয়া উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম ছিল “Accord on Fire and Building Safety in Bangladesh” এবং “Alliance for Bangladesh Worker Safety”, যেখানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড অংশ নেয়। এই চুক্তির অধীনে প্রায় ২,০০০ এর বেশি কারখানায় অগ্নি নিরাপত্তা, বৈদ্যুতিক ঝুঁকি ও কাঠামোগত দুর্বলতার পরিদর্শন হয়। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ কারখানায় সংস্কার কার্যক্রম আংশিক বা পুরোপুরি সম্পন্ন হয়েছে (Accord-এর ২০২১ সালের শেষ রিপোর্ট অনুযায়ী)।
ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য আন্তর্জাতিক তহবিলের মাধ্যমে প্রায় ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ বিতরণ করা হয়। তবে বাস্তবতায় দেখা গেছে, বহু শ্রমিক চিকিৎসা, পুনর্বাসন বা মানসিক ট্রমার পূর্ণ সমাধান পাননি। অনেক আহত শ্রমিকের পরিবার ক্ষতিপূরণের অর্থ এককালীন পেলেও, দীর্ঘমেয়াদী সহায়তা বা সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি।
তাছাড়া নিরাপত্তা সংস্কার মূলত বড় ব্র্যান্ডের কারখানায় বেশি কার্যকর হয়েছে। ছোট ও স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদন করা বহু কারখানায় এখনো নিরাপত্তা মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
এ ছাড়া, শ্রমিক অধিকার সংক্রান্ত আন্দোলন এখনও দমন-পীড়নের শিকার হয়; বিশেষ করে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা, হয়রানি এমনকি চাকরিচ্যুতির অভিযোগ এসেছে একাধিকবার।
বেচে যাওয়াকর্মীদের বর্তমান অবস্থাঃ
রানা প্লাজার ধস পেরিয়ে গেছে এক যুগ। অথচ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া জীবনের কান্না আজও থামেনি। আহত শ্রমিকদের অনেকেই এখনও বেঁচে আছেন, কিন্তু সেই বেঁচে থাকা যেন কেবল শ্বাস নেওয়ার আর্তি। শারীরিক পঙ্গুত্ব, মানসিক অবসাদ, আর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তাদের জীবনকে এক অবর্ণনীয় দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছে। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ২০২৩ সালের জরিপ বলছে, আহতদের অর্ধেকেরও বেশি এখনও কাজহীন, এবং প্রায় ৯০ শতাংশের জীবন আটকে আছে বেকারত্বের বন্দিশালায়।
তাদের শরীরে শুধু ক্ষতের দাগ নয়, রয়েছে অদৃশ্য যন্ত্রণার দলিল। কৃত্রিম অঙ্গ নিয়ে হাঁটতে গিয়ে প্রতিবার নিজের অক্ষমতা অনুভব করেন তারা। সুমি আক্তারের মতো অনেকেই আজও প্রতি দু’বছরে একবার কৃত্রিম পা পাল্টানোর জন্য ঋণের বোঝায় ডুবে যাচ্ছেন। আর মানসিক যন্ত্রণা? সেটার কোনো পরিমাপ নেই। প্রতিটি রাতে, তারা আবার শুনতে পান ধসে পড়া দেয়ালের শব্দ, অনুভব করেন চাপা পড়ে যাওয়া সহকর্মীর আর্তনাদ। বেঁচে থাকলেও তারা যেন ধ্বংসস্তূপের কোনো এক কোণে আটকে আছেন চিরকাল।
দুর্ভাগ্যের কথা, পুনর্বাসন বা সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার বেশিরভাগই কাগজেই থেকে গেছে। হাতে গোনা কিছু আর্থিক সহায়তা ছাড়া আহত শ্রমিকরা এখনো চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে ব্যর্থ, সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে ব্যর্থ, স্বপ্ন দেখতে ব্যর্থ। তাদের অনেকের সংসার ভেঙে গেছে, আত্মীয়স্বজন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এক সময়ের কর্মঠ হাতগুলো এখন সমাজের করুণ দৃষ্টির সামনে ভিক্ষুকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের জীবন কোনো সাধারণ জীবনের গল্প নয়, এটা এক অব্যক্ত কান্নার ইতিহাস। তারা বেঁচে আছেন ঠিকই, তবে প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে বয়ে বেড়াচ্ছেন অনাদায়ী বিচার, অবহেলা আর সমাজের নিষ্ঠুর ভোলাভালার অপরাধ। ইতিহাসের পাতায় রানা প্লাজা ধস হয়তো একটি তারিখ মাত্র, কিন্তু যারা সে ধসের নিচে হারিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের জন্য এটি প্রতিদিনের নিরব কান্না, অবিরাম, নির্মম।
ঘটনার পূনারাবৃত্তিঃ
রানা প্লাজার ধস (২৪ এপ্রিল ২০১৩) বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১১৩৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু এবং সহস্রাধিক মানুষের আহত হওয়ার এই ট্র্যাজেডি গোটা বিশ্বকে নড়িয়ে দিয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল, এবার হয়তো শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে।
কিন্তু সময়ের স্রোতে সেই প্রতিশ্রুতি অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। ১৬ আগস্ট ২০২১ সালে গাজীপুরের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। শ্রমিকদের নিজেদের চেষ্টায় আগুন নেভাতে হয় যেখানে পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা ছিল না। এরপর ১৮ নভেম্বর ২০২৪-এ গাজীপুরের পানিশাইল এলাকায় আরেকটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যেখানে তিনজন শ্রমিক আহত হন।
২০২৩ সালের এপ্রিলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) তাদের প্রতিবেদনে জানায়, রানা প্লাজার এক দশক পরেও শ্রমিক নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এখনো শ্রমিক নিরাপত্তা উদ্যোগে যোগ দেয়নি, ফলে অনেক কারখানায় ঝুঁকি থেকেই গেছে।
সবশেষ ২০২৫ সালের জানুয়ারির তথ্য বলছে, বড় কারখানাগুলোর প্রায় ৮০% কিছুটা নিরাপত্তা উন্নয়ন করেছে, তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলোর অবস্থা এখনও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অর্থাৎ, কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও সামগ্রিকভাবে সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হয়নি।
রানা প্লাজার ধস থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা ছিল আমাদের। কিন্তু বাস্তবে এখনও শ্রমিকরা অনিরাপদ জীবন নিয়ে কাজ করেন। নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবতার মাঝের এই বিপুল ব্যবধান প্রতিটি বিবেকবান মানুষের কাছে এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে।
এক যুগ পর আমাদের শিক্ষানীয় বিষয়সমূহ:
রানা প্লাজা ধসের এক যুগ পেরিয়ে এসেও বাস্তবতা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় — কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, কঠোর বাস্তবায়ন ও নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন।
প্রথমত, আমরা শিখেছি যে, ভবনের নিরাপত্তা ও ইঞ্জিনিয়ারিং মান নিশ্চিত না করলে হাজারো জীবন হুমকিতে পড়ে। শুধুমাত্র লাভের পেছনে ছুটলে তার মাশুল দিতে হয় অসংখ্য পরিবারকে কান্নার স্রোত বইয়ে।
দ্বিতীয়ত, শ্রমিকদের জীবনকে মূল্য দেয়া শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যও অপরিহার্য। শ্রমিকদের নিরাপত্তা ছাড়া টেকসই শিল্প সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, আমরা বুঝতে পেরেছি, নিয়ন্ত্রণ সংস্থার গাফিলতি, দুর্নীতি এবং দায়িত্বহীনতার ফলাফল কত ভয়াবহ হতে পারে। নিয়ম থাকলেই হবে না — নিয়মের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে ন্যায়, নিষ্ঠা এবং মানবিকতার সাথে।
চতুর্থত, অন্তর্জাতিক চাপ বা দাতা দেশের তাগিদে নয়, বরং নিজেদের বিবেকের তাগিদেই আমাদের শ্রমিক নিরাপত্তা ও মানবাধিকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সবশেষে, রানা প্লাজা আমাদের শিখিয়েছে — সময়ের প্রয়োজনে কিছু উন্নয়ন ঘটলেও, চোখ বন্ধ রাখলে ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে।
রানা প্লাজার ধসের মতো মর্মান্তিক ঘটনা যাতে আর না ঘটে, তার জন্য শুধু আইন নয়, দরকার মানবিক দায়বদ্ধতা, সততা এবং শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ।
রানা প্লাজার করুণ স্মৃতি ও আমাদের করণীয়
একটি অনিয়ন্ত্রিত ভবন, অবহেলা, কর্পোরেট লোভ এবং সরকারি তদারকির অভাব — এই চারটি উপাদান মিলে রচনা করেছিল বিভীষিকার ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলের দিনটি। মৃত্যু ছিল অনিবার্য, আর চিৎকারে আকাশ ভারী হয়েছিল। অনেকে চিরদিনের জন্য হারিয়েছেন তাদের পরিবার, স্বপ্ন, সম্ভাবনা। ক্ষতিপূরণ আর মানবিক সহায়তা কিছুটা দিয়েছে আর্থিক সান্ত্বনা, কিন্তু ফিরিয়ে দিতে পারেনি হারিয়ে যাওয়া জীবনগুলো।
রানা প্লাজার ধস আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে — “মানুষের জীবন কখনোই মুনাফার চেয়ে সস্তা নয়।” তারপরও, এক যুগ পেরিয়ে, অগ্নিকাণ্ড, বিল্ডিং দুর্বলতা ও শ্রমিক নিরাপত্তার ঘাটতি আজও মাঝে মাঝে নতুন করে ব্যথিত করে।
আমাদের করণীয় তাই আর বিলম্বের নয়:
রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ভেসে আসা আর্তনাদ যেন কেবল ইতিহাসের পাতায় বন্দী না থাকে, বরং প্রতিটি নীতিনির্ধারক, মালিক, ক্রেতা এবং নাগরিকের বিবেককে আজীবন প্রশ্ন করতে থাকে। কারণ উন্নয়ন তখনই সত্যিকার অর্থে সফল, যখন তার মূল ভিত হয় নিরাপদ শ্রম, ন্যায্য অধিকার ও মানবিক মর্যাদা।
মো: আমিনুল হক, সিনিয়র ম্যানেজার (মানব সম্পদ, প্রশাসন ও কমপ্লায়েন্স)
ডিকে গ্লোবাল ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড, ডিকেজি গ্রুপ।
মতামত লিখুন :