ডেস্ক রিপোর্ট : পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ২০১৪-১৫ পর্ষদের সহসভাপতি রিয়াজ-বিন-মাহমুদ। সংগঠনে তার সদস্যপদ রয়েছে একাধিক কারখানা ইউনিটের নামে। এর মধ্যে রয়েছে লা-বেলে অ্যাপারেলস (পিভিটি), লা-বেলে ডিজাইন (পিভিটি), লা-বেলে নিটিং (পিভিটি), লা-বেলে সোয়েটার (পিভিটি), স্টিলভল নিটওয়্যার্স ও ট্রেন্ডি সোয়েটার লিমিটেড। অথচ এ কারখানাগুলোর কোনোটিরই এখন অস্তিত্ব নেই। সংগঠনটির বর্তমান পর্ষদের সহসভাপতি হিসেবে আছেন ফেরদৌস পারভেজ বিভন। সংগঠনে ক্রিয়েটিভ শার্টস হাউজ লিমিটেড ও ক্রিয়েটিভ টেক্স লিমিটেডের মালিক হিসেবে তার সদস্যপদ রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও কারখানাগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিজিএমইএ পরিচালিত সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বিজিএমইএর বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৪ হাজার ২৯৬। ২০১৫ সালে সংগঠনটি নথিভুক্ত কারখানাগুলোর মধ্যে একটি সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষায় সরেজমিন পরিদর্শনে অনেক সদস্যপদের কাগুজে ঠিকানায় কারখানার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। সমীক্ষার ফল অনুযায়ী বিজিএমইএতে নথিভুক্ত কারখানাগুলোর মধ্যে ১ হাজার ১৬৩টি বর্তমানে বন্ধ। এর মধ্যে ১০ শতাংশ বা ১১৬টি কারখানার ঠিকানায় ভুল রয়েছে। বাকি ১ হাজার ৪৭ কারখানার মধ্যে অস্তিত্ব নেই অধিকাংশেরই। এর মধ্যে সংগঠনটির সাবেক ও বর্তমান একাধিক নেতা ও বহু সক্রিয় সদস্যের কারখানাও রয়েছে।
অস্তিত্বহীন অধিকাংশ কারখানা ঢাকা শহর ও এর আশপাশ এলাকার ঠিকানায় অবস্থিত। এর মধ্যে রয়েছে রামপুরা, মালিবাগ, খিলগাঁও, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, মহাখালী, কারওয়ান বাজার, বনানী, গুলশান, বারিধারা, মতিঝিল, পল্টন, কাকরাইল, ইস্কাটন, মগবাজার, তেজগাঁও, উত্তরা। এছাড়া ফতুল্লা, গাজীপুর, বোর্ড বাজারের কিছু কারখানাও এ তালিকায় আছে।
শুধু বিজিএমইএরই নয়, বারিধারার ক্রনি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পোশাক খাতের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি এএইচ আসলাম সানি। অথচ সংগঠনটির সদস্যপদ পেতে ব্যবহূত ইউনিটটির কোনো অস্তিত্ব নেই। বিজিএমইএ, বিকেএমইএর নেতারা ছাড়াও অস্তিত্ব নেই এমন কারখানার তালিকায় আছে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ.কে. আজাদের হা-মীম ফ্যাশনস লিমিটেড, হা-মীম স্পোর্টসওয়্যার ও দ্যাটস ইট ফ্যাশনস লিমিটেড।
এ তালিকায় রয়েছেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস। সংগঠনের নথিতে তার চাং হিং সোয়েটার (বিডি), ফারনুর সোয়েটার্স ও ইম্পেরিয়াল সোয়েটার্স (বিডি) লিমিটেডের কথা উল্লেখ আছে। আরো আছেন সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মূর্শেদী। তার কারখানার মধ্যে আছে ডর্নিক অ্যাপারেল, ফনটিনা ফ্যাশন, পাস্টেল অ্যাপারেলস, সুপ্রিম অ্যাপারেলস লিমিটেড ও টেক্সাস ড্রেসেস।
এছাড়া সংগঠনটির সাবেক পরিচালক এ. রাজ্জাক সাত্তারের ক্রেস্ট গার্মেন্টস লিমিটেড, ইউতাহ গার্মেন্টস, ইউতাহ অ্যাপারেল, ইউতাহ নিটওয়্যারও এ তালিকায় রয়েছে। রয়েছে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মোজাফ্ফর উদ্দিন সিদ্দিকীর নিম্মি অ্যাপারেলস। বিজিএমইএর বর্তমান পরিচালক রেজওয়ান সেলিমের সফটেক্স কটন (পিভিটি) লিমিটেড ইউনিট-২ ও সাবেক পরিচালক মশিউল আজমের ফেম নিটওয়্যার্স লিমিটেড রয়েছে এ তালিকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তালিকাভুক্ত কারখানার মধ্যে অনেকেই কমপ্লায়েন্স অব্যবস্থাপনার কারণে বিদ্যমান স্থানে কারখানা বন্ধ করেছেন। অনেকে কারখানার উত্পাদন বন্ধ হলেও সদস্যপদ রেখে দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে মালিকানা পরিবর্তন থাকলেও নতুন মালিকের নামে সদস্যপদ পরিবর্তন হয়নি। আবার অনেক কারখানার সদস্যপদ শুধু সংগঠনের নির্বাচনে ভোটার হিসেবে ব্যবহারের জন্য নামসর্বস্ব। এছাড়া তালিকায় ব্যাংকিং খাতের আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠান হল-মার্কও রয়েছে। পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটা তাজরীন ও এর মূল গ্রুপ তুবার নামও রয়েছে এতে।
যোগাযোগ করা হলে সভাপতি আবদুস সালাম মূর্শেদী বণিক বার্তাকে বলেন, তালিকাভুক্ত আমার কারখানাগুলো একটি নতুন স্থানে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। তবে শুল্ক বা বন্ড সুবিধার জন্য আগের ঠিকানাটি পরিবর্তন প্রক্রিয়াধীন আছে। আর অন্য কারখানাগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ থাকলেও এখন আবার চালু করা হয়েছে।
এত কারখানা অস্তিত্বহীন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পোশাক খাতের কারখানাগুলো গড়ে ওঠে কোটা পদ্ধতির সময়ে। সে সময় অনেক কারখানাই স্বল্পসংখ্যক মেশিন নিয়ে ভাড়া বাড়িতে স্থাপিত হয়। পরে কোটা পদ্ধতি উঠে যাওয়ায় অনেক কারখানা বন্ধ হলেও শুধু নামে থেকে যায়। আর তাজরীন ও রানা প্লাজা ঘটনার পর কমপ্লায়েন্সের কারণে অনেক কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন উদ্যোক্তারা। এভাবে অনেক কারখানা নামে থাকলেও বাস্তবে অস্তিত্ব নেই।
এআইএস সোয়েটারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০০৮ সালে নন-কমপ্লায়েন্সের কারণে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। সদস্যপদ কার্যকর আছে, কারণ কারখানা চালু করতে যেমন সময় লাগে, তেমনি বন্ধ করারও একটি প্রক্রিয়া রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সদস্যপদও বাতিল হবে।
পলমল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আল-হামরা গার্মেন্টস লিমিটেড। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম সাজ্জাদুল করিম বলেন, দুই থেকে আড়াই বছর আগে কারখানায় একটি ফাটল ধরা পড়ে। পরে আমরা এটি সংশোধনের উদ্যোগ নেই। ক্রেতা প্রতিষ্ঠান জানতে পারলে তারা এসজিএস ও ব্যুরো ভেরিটাসের মাধ্যমে মূল্যায়ন করিয়ে উত্পাদন বন্ধ রাখার সুপারিশ করে। পরে আমরা ইউনিটটি পুরোপুরি বন্ধ করে দিই।
আফরোজ নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজাম উদ্দিন মজুমদার। তিনি বলেন, কারখানাটির বিদ্যমান স্থানে শুধু নিটিং করা হয়। পরিকল্পনা ছিল আরো মেশিন স্থাপন করে সরাসরি রফতানি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হব। কিন্তু পরে আমি মালিকানা ছেড়ে দিই। এখনো কারখানাটি সাব-কন্ট্র্যাক্টিং পদ্ধতিতে চালু আছে। সদস্যপদে কেন হালনাগাদ হয়নি, তা নতুন মালিকপক্ষ বলতে পারবে।
বলাকা স্টিচ প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাশেদ শাহরিয়ার বলেন, বিজিএমইএর তথ্যে কোনো ভুল আছে। কারণ আমার কারখানাটি সম্পূর্ণ সচল। তবে বিজিএমইএর সদস্য অনেক কারখানাই নামসর্বস্ব। ভোটের রাজনীতির জন্য এগুলো ব্যবহার করা হয়।
বেবিস ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ২০০৫ সালে আমার কারখানাটি বন্ধ হয়। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পোশাকের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় পরিবর্তনের ফলে এটি বন্ধ করতে বাধ্য হই। কারণ ওই প্রতিষ্ঠানের নতুন মালিক বাংলাদেশে আমার কারখানা থেকে পণ্য ক্রয় করতে চাচ্ছিলেন না। এদিকে আমার শ্রমিকরা শুধু শিশু পোশাকের জন্য দক্ষ ছিল। পরে নতুন পণ্য উত্পাদনের চেষ্টা করেও আমি উত্পাদন শুরু করতে পারিনি। কারখানা না থাকলেও এ খাতে একটা সময় ছিলাম বলেই সদস্যপদ জীবিত রেখেছি।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের কারখানাগুলোর সমীক্ষা এখনো চলমান রয়েছে। সমীক্ষায় সরাসরি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান-বিষয়ক তথ্যও উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, বিজিএমইএ থেকে কাঁচামাল ব্যবহারের অনুমোদন ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন (ইউডি) নিয়ে সরাসরি রফতানি প্রক্রিয়ায় জড়িত কারখানা আছে ১ হাজার ৬১৮টি। ইউডি নেয় না কিন্তু সক্রিয় সদস্য ৮৭২টি।
সার্বিক বিষয়ে বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, পোশাক খাতের শুরুর দিকে সবাই ছোট আকারে কারখানা শুরু করে। অস্তিত্ব নেই এমন কারখানাগুলোর বেশির ভাগই ভাড়া করা ভবনে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছিল। এখন অনেকে অন্য স্থানে বড় আকারের কারখানা স্থাপন করেছেন। এর মধ্যে সংগঠনের নেতারা আছেন, সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তিনি আরো বলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি স্বচ্ছ তথ্যভাণ্ডার তৈরির কাজ চলছে। এজন্যই সংগঠনের সদস্যদের সঠিক পরিস্থিতি যাচাই-বাছাই করতে সমীক্ষাটি করা হয়। সমীক্ষায় পাওয়া বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে অধিকাংশেরই কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। আমরা আরো একটি সমীক্ষা চালাব। বন্ধ বা কারখানার অস্তিত্ব নেই এমন মালিকরা যদি ব্যবসায় ফিরে আসতে চায়, তাহলে তাদের সদস্যপদ রাখা হবে।
সৌজন্যে : দৈনিক বনিক বার্তা
মতামত লিখুন :