Logo

বাংলাদেশে আইএস সম্পৃক্ততা : হুমকির মুখে পোশাক শিল্প

Fazlul Haque
শনিবার, জুলাই ৯, ২০১৬
  • শেয়ার করুন

ফজলুল হক, নিজস্ব প্রতিবেদক : ১৯৮০ সালে সীমিত পরিসরে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের পোশাক খাত অতি স্বল্প সময়েই শিল্পের মর্যাদা পায়। কয়েক বছরের মাথায় পোশাক শিল্প সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের উৎসে পরিণত হয়। বর্তমানে মোট রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে পোশাক খাতের হাত ধরে। এ খাতটি প্রায় ২ কোটি মানুষের রুটি রোজগারের উৎসে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে বর্তমানে সরাসরি জড়িত রয়েছেন ৪৪ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ৩৫ লাখই নারী শ্রমিক। এর বাইরে আরও ৪০ লাখ লোক কাজ করেন পোশাক শিল্পের সহায়ক বিভিন্ন শিল্পে। মোট ২ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা পোশাক খাতনির্ভর।

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি এই পোশাক শিল্প খাতকে ধ্বংস করার লোকের অভাব নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে  ওঁত পেতে আছে দেশি বিদেশী ষড়যন্ত্র। তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকান্ড ও রানা প্লাজা ধ্বস দেশের পোশাক খাতকে পিছিয়ে দিয়েছে অনেকখানি। অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সসহ আঞ্চলিক নানা চুক্তি, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার শক্ত অবস্থান, ব্রেক্সিট ইস্যু, ভারতের দেয়া প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা বিভিন্ন বিষয়গুলো এমনিতেই বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে বাড়তি চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

সম্প্রতি ১ জুলাই গুলশানের আর্টিশান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা পোশাক শিল্পের উপর যেনো মরার উপর খরার ঘাঁ। গুলশানে আইএস সন্ত্রাসীদের জঙ্গী হামলা দেশের পোশাক খাতকে চরম হুমকীর মুখে ফেলে দিয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির গার্মেন্টস সম্পর্কিত ব্যবসায়ীরা, গুলশানে সন্ত্রাসী হামলার পর বাংলাদেশে তাদের নির্ধারিত সফর বাতিল করেছে। বাংলাদেশে কর্মরত সেসব কোম্পানির বিদেশিকর্মীদের সতর্ক থাকতে বলেছে কর্তৃপক্ষ। অভিজাত আবাসিক হোটেলগুলোতে পূর্ব রিজার্ভেশন গুলো বাতিল করা করেছে

গুলশানের জঙ্গি হামলায় ১৭ জন বিদেশী নাগরিক হত্যার পর বড় ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশের ২৬ বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্টস শিল্প। ইতিমধ্যে, জাপানের পোশাক খাতের ব্র্যান্ড ‘ইউনিকলো’ বাংলাদেশে তাদের সফর স্থগিত করেছে৷ শুক্রবার রাতে ঢাকায় সন্ত্রাসী হামলায় সাতজন জাপানি নাগরিকসহ ২০ জন নিহত হওয়ার প্রেক্ষিতে এমন অবস্থান নিয়েছে ইউনিকলোর মূল কোম্পানি ফাস্ট রিটেইলিং৷ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ঢাকার ওই সন্ত্রাসী হামলার পর বাংলাদেশের ২,৬০০ কোটি ডলারের গার্মেন্টস শিল্পখাতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে৷ জাপানের ইউনিকলো থেকে শুরু করে মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার বা গ্যাপ ইনকর্পোরেশনের মতো বড় বড় গার্মেন্টস রিটেইলাররা বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ নিয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে৷

ইউরোপ-অ্যামেরিকার দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরেই অবস্থান বাংলাদেশের৷ তাই গুলশান হামলার পর বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ‘পোশাক শিল্পের’ ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত হয়ে উঠছেন দেশের গার্মেন্টস মালিকরা৷

বার্তা সংস্থা বিবিসি’র খবরে বলা হয়, সুইডেনের এইচএন্ডএম-সহ অন্য যেসব নামজাদা বিদেশী পোশাক প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে ব্যবসা রয়েছে তারা বলছে তারা বাংলাদেশ থেকে নিরাপদ কোন দেশে কার্যক্রম স্থানান্তর করা হবে। এর আগে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে।

এদিকে বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, বিদেশি রিটেইলাররা বাংলাদেশের দিকে ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখবে৷ কিন্তু এ শিল্পের অনেক বিশেষজ্ঞের যুক্তি, শুধু বাংলাদেশই নয়; সস্তা শ্রমিক পাওয়া যায়, এমন অনেক উন্নয়নশীল দেশেই সন্ত্রাসবাদ সংশ্লিষ্ট অস্থিরতা দানা বেঁধেছে৷ গত বছর থেকে ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা প্রমাণ করে, শুধু উন্নয়নশীল দেশেই সীমাবদ্ধ নেই চরমপন্থি সহিংসতার ঝুঁকি৷ বিজিএমইএ-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ‘‘এই ঘটনার পর বিদেশিরা আর বিনিয়োগ করতে চাইবে না৷ পোশাক শিল্পের জন্য এটা একটা ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে৷ আমরা আসলেই ভীষণ উদ্বিগ্ন৷”

ওদিকে পশ্চিমা ক্রেতারা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পর্যালোচনা করতে পারে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতা ও বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাতে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছে হফিংটনপোস্ট।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ গরিব রাষ্ট্র। তার বৈদেশিক আয়ের ৮০ শতাংশ আসে পোশাক রপ্তানি থেকে। এই সেক্টরে দেশের ৪০ লাখ কর্মী নিয়োজিত এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো ইউরোপে পোশাক রপ্তানিতে শুধু চীনই তাদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।

অনন্ত গার্মেন্টেসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর শহিদুল হক মুকুল রয়টার্সকে বলেছেন, ‘এই ঘটনা স্পস্টভাবেই আমাদের উপর প্রভাব ফেলবে। নিরাপত্তাজনিত কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও চায়নার মতো দেশের আমদানিকারকরা আমাদের দেশে আসতে সতর্ক হবে।’

তিন বছর আগে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১১শ’র বেশি শ্রমিক নিহত হওয়ার পর নিরাপত্তার কারণে অনেক ফ্যাক্টরি তাদের রপ্তানি বাণিজ্য হারায়। তবে ওই ঘটনার পর বাংলাদেশের গার্মেন্টস আবার দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত রপ্তানি ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

কিন্তু হফিংটনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রানা প্লাজার চেয়ে শুক্রবারের ঘটনা বিদেশীদের জন্য আরো বড় চ্যালেঞ্জ। হামলাকারীরা এমন একটি জায়গায় হামলা করেছে সেখানে বিদেশীদেরই বেশি যাওয়া-আসা ছিল।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এরকম ভয়ঙ্কর ঘটনা কখনোই ঘটেনি। এটা আমাদের ভাবমূর্তির প্রতি ভয়াবহ চপেটাঘাত। এই ঘটনা আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর চাপ সৃষ্টি করবে। তবে কি পরিমাণ চাপ পড়বে সেটা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।’

ফরাসি-ভিত্তিক একটি পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী বলেছেন, আগামী দিনে ব্যবসায় একটি গভীর মন্দা ভয় করছি।

কিন্তু অন্যান্য শিল্পখাতে জড়িত ব্যক্তিরা বলেছেন, নিরাপত্তা উদ্বিগ্নতা কাটাতে পশ্চিমা গ্রাহকদের সঙ্গে বাংলাদেশের বাইরে বৈঠক হতে পারে। যেমন সিঙ্গাপুর বা হংকংয়ের মতো এশিয়ার শহরগুলোতে এটা হতে পারে। কিছুদিন আগেও এই রকম আলোচনা শুরু হয়েছিল।

ভারতের গুরগাও ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অরিয়েন্ট ক্র্যাফটের প্রধান সুধীর ধিংরা বলেন, ‘এই ঘটনা নিঃসন্দেহে তৈরি পোশাক শিল্পে প্রভাব ফেলবে।’

এছাড়া সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে৷ শামীমা রহিম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘দেশের এমন সংকটময় মুহূর্তে প্রয়োজন একটা জাতীয় ঐক্য৷ গুলশান হামলায় নিহতদের মধ্যে ন’জন ছিলেন তৈরি পোশাকের ইটালিয়ান ক্রেতা৷ তাঁদের নিহতের ঘটনায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উপর অবশ্যই বিরূপ প্রভাব পড়বে৷ যদি সেটি ঘটে তাহলে ক্রেতারা বাংলাদেশের বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে ভারত বা চীনমুখী হবেন৷ আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে এ দেশের অর্থনীতি চরম হুমকির মুখে পড়বে৷”

আলমগীর নাহিদ লিখেছেন, ‘‘গুলশান হামলা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প ব্যবসায় প্রভাব ফেলবেই, প্রভাবিত হবে এ দেশের অর্থনীতি৷ এ দেশে আগত বিদেশিদের অধিকাংশই এই শিল্পটির সাথে সংশ্লিষ্ট৷ সুতরাং এ ঘটনার পর স্বভাবতই তাঁরা আর এ দেশে আগমনে নিরাপদ বোধ করবেন না৷”

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে জঙ্গী সংগঠন আইএস এর তৎপরতা নেই অস্বীকার করার জো নেই। অতি দ্রুত সরকার আইএসসহ সকল জঙ্গী সংগঠনগুলো নির্মুল করতে না পারলে বিদেশীরা এদেশে আসা বন্ধ করে দেবে। ফলে বন্ধ হয়ে যাবে বিদেশী বিনিয়োগ।  নানামুখী চাপে ঝুকিঁর মুখে থাকা দেশের প্রধান চালিকা শক্তি পোশাক খাতকে রক্ষা করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, সরকার, বিরোধী দলসহ সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন।