Logo

বাউশিয়ায় গার্মেন্টস পল্লী স্থাপন অনিশ্চিত, বিজিএমই এর চরম অসহযোগিতা

Fazlul Haque
রবিবার, এপ্রিল ৩, ২০১৬
  • শেয়ার করুন

আরএমজি টাইমস ডেস্ক : রাজধানী ঢাকার ২৮ কিলোমিটার দূরে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বাউশিয়ায় গার্মেন্টস পল্লী বাস্তবায়ন প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর এ জন্য দায়ী করা হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন (বিজিএমইএ)-এর নেতাদের আন্তরিকতার অভাব ও গড়িমসিকে। অথচ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিজিএমইএ এবং চীনা প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্টাল ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং করপোরেশন লিমিটেডের (ওআইএইচ) যৌথ উদ্যোগে বাউশিয়ায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ছিল। এ লক্ষ্যে বিজিএমইএর সঙ্গে চীনা প্রতিষ্ঠান ওআইএইচের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তিও হয়েছিল। এখন বিজিএমইএর অসহযোগিতার কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, গার্মেন্টস মালিকরা রাজধানীর বাইরে কারখানা স্থানান্তর করতে চান না। গার্মেন্টস পল্লী স্থানান্তরে বিজিএমইএর নেতা ও দেশের বড় গার্মেন্টস কারখানা মালিকদের আগ্রহ কম। কারণ, ভাড়াটে কিংবা অংশীদারী ভবনে কারখানা রয়েছে এমন পোশাক কারখানা মালিকদের জন্য এই গার্মেন্টস পল্লী নির্মাণ করা হবে। বিজিএমইএর নেতৃত্বে থাকা বড় শিল্প মালিকদের এখানে কোনও স্বার্থ নেই। তাই এ প্রকল্পে তাদের আগ্রহও নেই। পল্লী স্থাপনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে দফায়-দফায় নানা উদ্যোগ নিতে বিজিএমইএকে অনুরোধ করা হলেও তাতে সাড়া দেয়নি বিজিএমইএ। এ অবস্থার মধ্যেই গত বছরের জুলাইয়ে ওআইএইচের ১০ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে গেছে। তাদের মনে হয়েছে, এ সব কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর পোশাকশিল্প মালিকরা এখানে প্লট নাও কিনতে পারেন। এ কারণে চীনা প্রতিষ্ঠানটিও বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গার্মেন্টস মালিকদের অসহযোগিতায় কারণে বাউশিয়ায় জমি অধিগ্রহণ করেও তা বাতিল করতে হয়েছে। গার্মেন্টস মালিকরা নিজেদের অর্থে কেনা জমিতে বাউশিয়ায় কারখানা করতে চান না। এ ক্ষেত্রে তারা সরকারের অর্থায়ন চান। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও জানানো হয়েছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে গার্মেন্ট মালিকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর পরামর্শও দিয়েছেন বলেও জানা গেছে। গার্মেন্টস মালিকদের এই অনীহার কারণে চীনা প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্টাল ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং করপোরেশন লিমিটেডও (ওআইএইচ) অনেকটাই পিছুটান দিয়েছে। বিষয়টি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ নিজেও অনেকটা বিরক্ত বলে জানা গেছে। এসব কারণে রাজধানী থেকে গার্মেন্টস শিল্প মুন্সীগঞ্জের বাউশিয়ায় স্থানান্তর অনেকটাই অনিশ্চিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, প্রায় এক দশক আগে এ প্রকল্পটি নেয়া হলেও ২০১৩ সালে এসে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ৫৩০ দশমিক ৭৮ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় সরকার। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বাউশিয়া, মধ্যম বাউশিয়া, পোড়ারচক, কাইচখালী ও চৌদ্দকাহনিয়া মৌজায় ৪৯২ একর জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে। ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর প্রথমবার, ২৫ নভেম্বর দ্বিতীয়বার, ১৯ ডিসেম্বর তৃতীয়বার এবং সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি চতুর্থবার জমির দাম ও ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭৭৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা নির্ধারণ করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমা দিতে বিজিএমইএকে নোটিস দেওয়া হয়। কিন্তু বিজিএমইএ টাকা না দেয়ায় অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বাতিল করে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়।

এর পরও প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ওই এলাকার জমির দামও দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে বিজিএমইএর সঙ্গে চীনা প্রতিষ্ঠান ওআইএইচের যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল, সে অনুযায়ী চীনা প্রতিষ্ঠানটির করা অর্থায়নে এখন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। কারণ খরচ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ।

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় তার উপস্থিতিতে বিজিএমইএ এবং চীনের ওরিয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং কোম্পানির মধ্যে বাংলাদেশে আরএমজি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নির্মাণের বিষয়ে স্বাক্ষরিত হয় একটি এমওইউ। এরই ধারাবাহিকতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে বিজিএমইএ এবং চীনা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়। এমওইউ স্বাক্ষরের পর ৫ মাসের মধ্যে প্রায় ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয় একশ পৃষ্ঠার একটি সম্ভাব্যতা যাচাই রিপোর্টও।

জানা গেছে, জমির মূল্য পরিশোধের অর্থ জোগাড়ের জন্য পোশাক শিল্পের মালিকরা নিজেরা কোনো অর্থ খরচ করতে চান না। তারা বিভিন্ন উৎস থেকে জমি কেনার টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করেন। দেশের ভেতর থেকে অর্থ না পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকালে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ওআইএইচের সঙ্গে ২০১৪ সালের ১০ জুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে বিজিএমইএ। ওই বছরের ৫ আগস্ট শিল্পপার্কের উন্নয়নের জন্য বিজিএমইএর আবেদনে ওআইএইচকে নিয়োগ দেয়ার প্রস্তাবে অনাপত্তি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিজিএমইএ-এর সঙ্গে চীনা প্রতিষ্ঠানটির একটি কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। তাতে শিল্পপার্কটি স্থাপনে ব্যয় ধরা হয় ২৩০ কোটি ডলার, যার পুরোটাই বিনিয়োগ করার কথা চীনা কোম্পানির। শিল্পপার্ক প্রতিষ্ঠার পর গার্মেন্ট মালিকদের কাছে প্লট বিক্রি করে এবং বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ভাড়া আদায় করে বিনিয়োগের সঙ্গে মুনাফার পরিকল্পনা ছিল চীনা প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু নানা কারণে চীনা প্রতিষ্ঠানের মনে হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর পোশাকশিল্প মালিকরা এখানে প্লট না-ও কিনতে পারেন। যে কারণে চীনা প্রতিষ্ঠানটিও বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট ওই সূত্র।মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে শিল্পপার্কে তিনশ থেকে পাঁচশটি তৈরি পোশাক কারখানা নির্মাণ করা হবে। এখানে আড়াই লাখ শ্রমিক কাজ করার সুযোগ পাবেন। প্রকল্পটি বাস্তবয়িত হলে বাংলাদেশে এটি হতো চীনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। তৈরি পোশাক কারখানার পাশাপাশি পাঁচ তারকা হোটেল, শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাসের সুবিধা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, পার্কিংসহ শিল্প কারখানায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। পার্কটিতে যেসব কারখানা গড়ে ওঠার কথা, তাতে বছরে ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করা সম্ভব হবে।

এদিকে, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে নিবন্ধন হওয়া চালু গার্মেন্টস কারখানার সংখ্যা ৫ হাজার ১৯০টি। এর মধ্যে ঢাকায় ২ হাজার ৫০০টি, গাজীপুরে ৮৭২টি, চট্টগ্রামে ৫২৮টি, নারায়ণগঞ্জে ১ হাজার ২১৮টি কারখানা রয়েছে। অন্য জেলাগুলোর মধ্যে ময়মনসিংহে ২৭টি, যশোরে চারটি, মৌলভীবাজারে তিনটি, টাঙ্গাইলে ১১টি, মুন্সীগঞ্জে তিনটি, সিরাজগঞ্জ ও রংপুরে একটি করে, কুমিল্লায় ছয়টি, বগুড়ায় ১২টি ও খুলনায় তিনটি তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা রয়েছে।এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানান, এই গার্মেন্টস পল্লীতে বিনিয়োগ এ যাবতকালে বাংলাদেশে বড় চীনা বিনিয়োগ। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ক্রেতাদেরও সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব হবে। কিন্তু নানা করণে এটি বাস্তবায়নে সামান্য সমস্যা তৈরি হয়েছে। তা অচিরেই ঠিক হয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করি। এ বিষয়ে বিজিএমইএ-এর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, চীনা প্রতিষ্ঠানটি এ প্রকল্পে কিভাবে কোন শর্তে অর্থ বিনিয়োগ করতে চায়, তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। বিষয়টি আমাদের জানানোর কথা ছিল। কিন্তু তারা বিজিএমইএকে এ বিষয়ে কিছুই জানায়নি। সুত্র: আজকের পত্রিকা