ফজলুল হক, নিজস্ব প্রতিবেদক : মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তম দুটি ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম ঈদুল আযহা। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় আত্মত্যাগের নিদর্শন স্বরূপ হালাল পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে ঈদুল আযহার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে প্রস্তুত দেশবাসী। ঈদ উদযাপনে মার্কেটগুলোতে পড়েছে উপচে পড়া ভীড়।সবার মনে ঈদের আনন্দ বিরাজ করছে। সরকারী বেসরকারী চাকরীজীবিরা ছুটির সাথে পাবে সন্তোষজনক ঈদ বোনাস আর চলতি মাসের বেতন। কিন্তু ঈদ সবার জন্য সমান আনন্দকর নয়। অনেকের জন্য তা অসহনীয় ভোগান্তির, দুশ্চিন্তা আর অভাবের। বাংলাদেশের অর্থনীতির মুল চালিকাশক্তি দেশের তৈরী পোশাক শিল্প। এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে প্রায় কোটি মানুষের হাসি কান্না। ঈদ আসলেই পোশাক শিল্প শ্রমিকরা ব্যাপক দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। ঈদের ছুটি আর বেতন-বোনাস নিয়ে নানা প্রশ্নের তৈরী হয় এসব শ্রমিকদের মনে। সময় মতো মিলবে কি ছুটি? বেতন বোনাস?
সর্বশেষ আপডেট, এখনো বোনাস পায়নি দেশের অর্ধেক পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। অনেক কারখানায় বোনাস দিলেও দেয়নি চলতি মাসের বেতন। অথচ প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সরকার আর কারখানার মালিদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর প্রতিশ্রুতি ছিল ২৪ আগস্টের মধ্যে সকল কারখানায় বোনাস আর ছুটির আগে চলতি মাসের বেতন পরিশোধ করবে।কিন্তু সরকারের নির্দেশনা যথাযথভাবে মানছে না অনেক কারখানার মালিকরা।
আশুলিয়ার পোশাক শিল্পাঞ্চলের একাধিক শ্রমিক জানান, এখনো অনেক কারখানায় বোনাস পরিশোধ করা হয়নি। কিছু কিছু কারখানায় বোনাস দিয়ে বেতন ঈদের পরে দেয়া হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। বেতন বোনাসের অনিশ্চয়তায় সবার মাঝে শঙ্কা বিরাজ করছে।
পোশাক শ্রমিক সফিকুল জানায়, প্রতিবছরই ঈদের সময় বেতন বোনাস নিয়ে ঝামেলা হয়। আমাদের প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দিতে সরকার মালিকপক্ষের কেনো এতো টালবাহানা করে! ঈদকে ঘিরে আমাদেরও অনেক প্লান থাকে। পরিবার পরিজনের সাথে ভালো কিছু মুহুর্ত কাটানোর ইচ্ছে তো আমাদের থাকতেই পারে।
পোশাক কর্মী সুফিয়া জানান, প্রতি বছর চেষ্টা করি গ্রামের লোকদের সাথে ভাগে কুরবানী দিতে। কিন্তু এবছর সেটাও হবে না। বন্যায় বাড়ী ঘর ডুবে গেছে। বন্যা পরবর্তীতে ঘর মেরামত করতে অনেক টাকা লাগবে। গ্রামে বাবা মা ভাইবোনসহ আমার সন্তানেরা থাকে। ঈদে এবার তাদের জন্য কিছুই করতে পারবো না। এখনো বোনাস পাইনি। বেতনটাও পাবো কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে।
বিভিন্ন কারখানার একাধিক শ্রমিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, অন্য বছরের তুলনায় এবারের ঈদে অনেকেই গ্রামে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আশুলিয়ার পোশাক শ্রমিকদের অধিকাংশই উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা। ঢাকা-টাঙ্গাইল হাইওয়ে রাস্তায় চার লেনের কাজ চলায় আগেরবারের তুলনায় এবার রাস্তার অবস্থা খারাপ। এখনি তীব্র যানজট দেখা যাচ্ছে। ঈদের ছুটিতে তা যানজট আরও ভয়াবহ রুপ নেবে। বেতন বোনাস না পাওয়া এসব শ্রমিকরা তীব্র যানজটসহ নানান ভোগান্তি ঠেলে বাড়ীতে গিয়েও ভোগান্তির শিকার হবে। হয়তো অনেকের মাথা গোজার ঠাঁইটুকুও ভেসে আছে পানিতে।
শ্রমিকরা অভিযোগ করে বলেন, পোশাক শ্রমিকরা নাকি দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। কিন্তু পোশাক শ্রমিকরাই মনে হয় এদেশে বেশি অবহেলিত। ঈদ বোনাস নিয়ে প্রতিবারই ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়। অথচ এটা আমাদের ন্যায্য অধিকার। যাদের জন্য আমরা দিনরাত পরিশ্রম করছি তারাই সবসময় আমাদের ঠকাতে চেষ্টা করে। অনেক কারখানা মালিকরা আমাদের কথা ভাববে তো দুরে থাকুক, সরকারী নিদের্শনাকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। অর্ডারের পর অর্ডার আসে তবুও বেতন বোনাসের বেলায় শুনতে হয় কোম্পানী লসে আছে, ঝামেলায় আছে।
এসময় একটি কারখানার ওয়েলফেয়ার অফিসার মমতা রানী পাল অভিযোগের সাথে রাগ ক্ষোভ মিশ্রিত করে বলেন, শুধু কারখানায় বেতন বোনাসই নয়, ঈদ উপলক্ষ্যে আমাদের ভোগান্তির শেষ নেই। টেলিভিশন দেখলেই টকশোতে দেখি পোশাক শিল্পের অবদানকে হাইলাইটস করা হয়। এ খাতের রপ্তানী আয় সব চেয়ে বেশি। আর তাতেই নাকি দেশে অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে রুপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের জন্য সরকার কি করে? ঈদে ছুটি পাই ৫/৬ দিন। বাড়ীতে যেতে আসতেই সময় লাগে চার দিন। রাস্তার বেহাল দশা আর তীব্র যানজটে ঈদে বাড়ী যেতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সারা বছর সড়কের খোঁজ থাকে না, ঈদের আগে শুরু হয় রাস্তা মেরামতের কাজ। তাতে আরও ভোগান্তি বাড়ে। আমরা যাদের জন্য দিনরাত্রি পরিশ্রম করছি তারা আমাদের ন্যায্য মজুরী দিতেও নানা বাহানা করে। কিন্তু কেনো?
ঈদকে সামনে রেখে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে নিদের্শনা ছিল সময়মতো বেতন বোনাস পরিশোধ করার কিন্তু অনেক কারখানা মালিকরাই সরকারের নিদের্শনা অমান্য করেছে। এদিকে সেতু ও যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে সকল চলাচলের উপযোগী করে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন।কিন্তু সরকারী এসব মন্ত্রী আমলাদের প্রতিশ্রুতিকে লোক দেখানো ফাঁকা বুলি হিসেবেই নিয়েছে শ্রমিকরা।
শ্রমিকরা মনে করে, প্রতিশ্রুতি আর নিদের্শনা দিয়েই দায়মুক্তি চায় সরকার। তারা বলেন, সঠিক সময়ে রাস্তার কাজ হলে ঈদের সময় চব্বিশ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিতে হয় না। আর যে সরকার ২৪ ঘন্টায় দেশের সকল রাস্তা ঠিক করে দেবে সে সরকার মানুষের ভোগান্তির কথা ভেবে কেনো বছরের বাকী ৩৬৪ দিন যথাযথ কাজ করে ঈদের জন্য রাস্তা ঠিক রাখে না? শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবছরই নির্দেশনা দিয়ে যায়, কিন্তু নিদের্শনা মানা না মানায় কোনো কঠোর নজরদারী বা জবাবদিহিতা থাকে না। যদি তা থাকতো তাহলে আমাদের এতো ভোগান্তির শিকার হতে হতো না। আমরা ফাঁকা বুলি আর প্রতিশ্রুতি নয়, ঈদকে ঘিরে সকল ভোগান্তির অবসান চাই।
মতামত লিখুন :