ডেস্ক রিপোর্ট: তিনটি খ্যাতনামা দেশীয় গ্রুপকে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। এই তিন গ্রুপ হচ্ছে আকিজ, হা-মীম ও নিটল-নিলয় গ্রুপ। প্রাথমিকভাবে এই তিনটি ব্যবসায়িক গ্রুপ বিদেশে মোট তিন কোটি ৭৪ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। বাংলাদেশী মুদ্রায় যা ৩০০ কোটি টাকা বেশি। অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলোর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারক কমিটি ‘অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’র বৈঠকে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েও দেয়া হয়েছে। আগামী যেকোনো বৈঠকে এ বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলো অনুমোদন পেতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (সাবেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ) সূত্রে জানা গেছে, তিন ব্যবসায়িক গ্রুপের প্রস্তাব অনুযায়ী মালয়েশিয়ায় দু’টি কোম্পানি অধিগ্রহণে আকিজ জুট মিলস লিমিটেড ২ কোটি মার্কিন ডলার, হাইতিতে একটি তৈরী পোশাক কারখানা স্থাপনে হা-মীম গ্রুপ ১ কোটি ৪৪ হাজার মার্কিন ডলার ও আফ্রিকার গাম্বিয়ায় একটি ব্যাংক (গাম্বিয়া কমার্স অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল ব্যাংক লিমিটেড) স্থাপনে নিটল-নিলয় গ্রুপ ৭০ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করতে চায়। বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি চেয়ে প্রতিষ্ঠান তিনটি ইতোমধ্যে পৃথকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছে। প্রচলিত বিধান অনুযায়ী, স্থানীয় উদ্যোক্তাদের ঢালাওভাবে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ নেই। তবে ‘কেস টু কেস’ ভিত্তিতে বিষয়টি বিবেচনার সুযোগ রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, বিদেশে ইকুইটি বিনিয়োগের আবেদন দিন দিন বাড়ছে। তবে স্থানীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশে কোম্পানি অধিগ্রহণে এত বিপুল অর্থ পাঠানোর নজির নেই। এ কারণে প্রস্তাব তিনটি অনুমোদনে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছে বলে সূত্র জানায়।
এ বিনিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদনের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নেয়ার সুপারিশ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যথেষ্ট উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। গত বছরের নভেম্বরের যা ছিল দুই লাখ ৭৭ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। এ তারল্য অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) কাক্সিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ন্যূনতম স্থানীয় বিনিয়োগ জিডিপির ৩২ ভাগ হওয়া প্রয়োজন। এ পর্যায়ে স্থানীয় বিনিয়োগ উৎসাহিত না করে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান করা যথাযথ হবে কি না তা সতর্ক বিবেচনার দাবি রাখে।’
সূত্র জানায়, দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিদেশে ইকুইটি বিনিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদনে বৈদেশিক রিজার্ভ পরিস্থিতি, বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবে ভারসাম্য, জিডিপির কাক্সিত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে স্থানীয় বিনিয়োগ বাড়ানো ইত্যাদি বিষয় পর্যালোচনা করে সতর্কভাবে তা বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিদেশে ইকুইটি বিনিয়োগের প্রস্তাব ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা হলে রিজার্ভের ওপর চাপ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
উপরোন্তু বিদেশে বিনিয়োগপ্রসূত রিটার্ন এ দেশে প্রত্যাবাসন হবে কি না, তাও নিশ্চিত নয়।
এসব দিক বিবেচনায় চারটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এগুলো হচ্ছে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা; ওই বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত উপার্জন ও মূল বিনিয়োগকৃত অর্থ দেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করা; প্রস্তাবিত খাতে অর্থ বিনিয়োগ করা হলে দেশ অধিকতর লাভবান হবে কি না, তা বিবেচনা করা এবং বিদেশে মূলধন বিনিয়োগের ফলে সেখানে এ দেশীয় কর্মসংস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করা।
রিজার্ভের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, বিদেশে ইকুইটি বিনিয়োগের প্রস্তাবের ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয় হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি। বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে সাত থেকে আট মাসের পণ্য ও সেবা আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হলেও বর্তমানে রিজার্ভ প্রবৃদ্ধি, রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ও রফতানি প্রবৃদ্ধির হার অত্যন্ত ধীর। এ ছাড়া গত ডিসেম্বর থেকে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি খাত উদ্বৃত্ত থেকে হ্রাস পেয়ে ঘাটতি অবস্থানে রয়েছে। এর বিপরীতে গত ১ মার্চ পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের স্থিতির পরিমাণ ৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। অন্য দিকে রিজার্ভের অর্থ থেকে প্রতি বছর দুই বিলিয়ন ডলার (২০০ কোটি ডলার) নিয়ে পাঁচ বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ‘বাংলাদেশ সার্বভৌম সম্পদ তহবিল’ এবং আড়াই বিলিয়ন ডলার দিয়ে ‘রফতানি উন্নয়ন তহবিল’ গঠন করেছে সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশে ইকুইটি বিনিয়োগের প্রস্তাব ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা হলে রিজার্ভের ওপর চাপ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের বিদেশী বিনিয়োগের বিষয় সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হলেও এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বেশ ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। এ ব্যাপারে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, ‘আমাদের দেশে এখন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ ও সামর্থ্য রয়েছে। অন্য দিকে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি ও প্রবাসী রেমিট্যান্সপ্রবাহ উল্লেখযোগ্যহারে হ্রাস পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আলোচ্য বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলো নামকরা প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে এবং তাদের বিনিয়োগ হতে প্রাপ্ত অর্থ দেশে প্রত্যাবাসনের সুযোগ রয়েছে। ভবিষ্যতে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ আরো হ্রাস পেলে এ ধরনের বিনিয়োগ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আহরণের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
মতামত লিখুন :