ডেস্ক রিপোর্ট : আশুলিয়ার পোশাক শিল্পাঞ্চলে শ্রম অসন্তোষের জেরে টানা পাঁচদিন বন্ধ থাকার পর গতকাল খুলেছে আশুলিয়ার বন্ধ সব পোশাক কারখানা। তবে কারখানা খোলার প্রথম দিনেই কাজে যোগ দিতে পারেননি দেড় হাজারের বেশি শ্রমিক। আন্দোলনের কারণে গত কয়েক দিনে ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন তারা।
ছাটাইকৃত শ্রমিকদের দায় কে নেবে, এমন প্রশ্নই ঘুরে ফিরছে সবার মাঝে। শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের পাশাপাশি অনেক সাধারণ শ্রমিকও ছাটাইয়ের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে অনেকেই।
কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, গতকালের কর্মদিবস শেষে ১৭টি কারখানার সাময়িক বরখাস্ত হওয়া শ্রমিক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৭৫। আর শিল্প পুলিশ সূত্র জানায়, গত কয়েক দিনে মোট ২৫টি কারখানায় ১ হাজার ৬১০ জন শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে। অন্যদিকে শিল্প পুলিশ ও সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বিত তথ্য বলছে, শ্রম অসন্তোষকে কেন্দ্র করে ছাঁটাই হয়েছে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক।
ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো, নানা অজুহাতে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, নিয়ম অনুযায়ী ছাঁটাইকৃত শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধ ও ছুটিকালীন বেতন বহাল রাখাসহ ১৫ দফা দাবিতে ১১ ডিসেম্বর থেকে আশুলিয়ার কিছু পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কর্মবিরতি শুরু করেন। এ কর্মসূচির একপর্যায়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করলে আরো বিরূপ পরিস্থিতির আশঙ্কায় ২০ ডিসেম্বর ৫৯টি পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারা প্রয়োগ করে মালিকপক্ষ। টানা পাঁচদিন বন্ধ থাকার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গত রোববার বন্ধ কারখানা খুলে দেয়ার ঘোষণা দেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)। এ ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল এসব কারখানা খুলে দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, ১৩ (১) ধারায় বন্ধ হওয়া ৫৯ কারখানার সবই গতকাল চালু হয়েছে। তবে এসব কারখানায় গতকাল প্রায় ১৫ শতাংশ শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত ছিলেন। শ্রমিক ছাঁটাই নিয়ে কোনো বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বলে সরকারি সংস্থাগুলো জানিয়েছে।
শিল্প পুলিশের মহাপরিচালক আবদুস সালাম বলেন, গত কয়েক দিনে ১ হাজার ৬০০-এর বেশি শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। তবে এ নিয়ে বিরূপ কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি।
তবে বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, কতজন ছাঁটাই হয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা এখনই বলা সম্ভব নয়। যারা ভাংচুর ও মারামারিতে অংশ নিয়েছেন, তারা ‘ক্রিমিনাল’। তাদের বিরুদ্ধেই মালিকপক্ষ আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়েছে।
জানা গেছে, শ্রমিকদের সাময়িক বরখাস্ত বা ছাঁটাই করা কারখানার মধ্যে আছে— উইন্ডি অ্যাপারেলস, সেতারা গ্রুপ, বাঁধন করপোরেশন, ইসলাম গ্রুপ, ডেকো ডিজাইন, শারমিন গ্রুপ, বান্দো ডিজাইন, নেক্সট কালেকশন, ডিকে নিট, ডিজাইনার জিন্স, আইডিএস গ্রুপ, ফাউন্টেন গার্মেন্টস, হা-মীম গ্রুপ, শেড ফ্যাশন, ডিকে গ্লোবাল, এএম ডিজাইন ও অনন্ত গ্রুপ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে ইসলাম গ্রুপের পোশাক কারখানায়। আর সবচেয়ে কম সংখ্যক শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে বাঁধন করপোরেশনে।
২১-২৪ ডিসেম্বর মোট পাঁচদিন কারখানা বন্ধ থাকার সিদ্ধান্ত থাকলেও ২৩ ডিসেম্বর থেকে একটি-দুটি করে কারখানা আংশিক সচল হতে শুরু করে। ২৪ ডিসেম্বর চারটি কারখানা চালু হয়। এদিন কারখানাগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশ শ্রমিক কাজে যোগ দেন।
সেড ফ্যাশন কারখানায় দুই বছর যাবৎ কাজ করছেন আমেনা নামে এক শ্রমিক। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে অভিযোগ করে বলেন, ‘আন্দোলনে উস্কানির মিথ্যা অভিযোগে তাকে ছাটাই করা হয়েছে। গতকালও কারখানায় কাজে এসে সারাদিন গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। এখন কাজ না পেলে পরিবারকে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে তাকে।’
একই কারখানার স্যুইং অপারেটর জরিনা ও অপারেটর লাকী নামে সন্তান সম্ভবা দুই শ্রমিক জানান, ‘আর দুই মাস পরেই তাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়ার কথা ছিলো। এখন কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের বিনাদোষে ছাটাই করে সেই ছুটি ও পাওনা টাকা থেকে বঞ্চিত করছে।
তারা আরও বলেন, ‘যদি মালিক আমাদের নাই রাখে, তাহলে আমাদের পাওনা বুঝিয়ে দিক। তাহলে আর অসুস্থ শরীর নিয়ে অর আমাদের কারখানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না।
তবে শ্রমিক ছাটাইয়ের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাননি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কারখানার কোনো কর্মকর্তা।
দ্যা রোজ এন্ড ড্রেসেস গার্মেন্টের জেনারেল ম্যানেজার বলেন, গত পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর সোমবার বিজিএমইএ-এর ঘোষণা অনুযায়ী বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়া হলে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেয়। তবে আজ শ্রমিকদের উপস্থিতি একশ ভাগ পূরণ করেছে। বর্তমানে টার্গেট অনুযায়ী তাদের উৎপাদন কাজ পুরো দমে চলছে। এছাড়াও কারখানায় বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে শ্রমিকদের দেহতল্লাশি মাধ্যমে ভেতরে প্রবেশ করানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে কর্মচঞ্চলতা ফেরায় আপাতত নিরাপত্তা ব্যবস্থা শিথিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিল্প পুলিশ-১ এর সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। তবে যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে বলেও জানান তিনি।
শ্রমিক ছাটাইয়ের ঘটনায় সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আকতার আরএমজি টাইমসকে বলেন, আশুলিয়ার সকল বন্ধ কারখানা খুলে দেয়ায় শ্রমিকরা আগ্রহ নিয়ে পুনরায় আগ্রহ নিয়ে কাজে যোগ দিচ্ছে। কিন্তু এভাবে শ্রমিক ছাটাই করলে শ্রমিকদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে যা বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন্য শুভকর হবে না।
মতামত লিখুন :