শ্রমিক বিক্ষোভে টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় অস্থিতিশীল থাকার পর ঢাকার সাভার-আশুলিয়া এবং গাজীপুর শিল্পনগরীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। গতকাল রবিবার এ দুই জেলার কোথাও শ্রমিক অসন্তোষের বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। কারখানাগুলোতে পুরোদমে চলেছে উৎপাদন কার্যক্রম। পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় বন্ধ থাকা অধিকাংশ কারখানাও চালু হয়েছে। শুধু গাজীপুরের টঙ্গীতে একটি কারখানার শ্রমিকরা আগস্ট মাসের বেতন পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন।
পরিদর্শনকালে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং শ্রম-সংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক সবুর হোসেন বলেন, ‘গত বুধবার এই কমিটি গঠন করা হয়। পরদিন কমিটির কার্যপরিধি ও কার্য পরিচালনার বিষয় নিয়ে সভা করা হয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে শিল্পাঞ্চলের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনের লক্ষ্যে সব অভিযোগ শুনতেই সরেজমিনে এসেছি। আশা করছি আজ (গতকাল) থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। সব কারখানা ধীরে ধীরে খুলে দেওয়া হবে। কোনো দাবিতে সড়ক ও কাজ বন্ধ করার কোনো প্রয়োজন নেই।’
সবুর হোসেন জানান, কারখানার মালিক, শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, আপত্তি, অভিযোগ তারা জানতে চান। এসব জানানোর জন্য ১৬৩৫৭-এই পাঁচ ডিজিটের হটলাইন নম্বর চালু করা হয়েছে। সেই সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, ই-মেইল আইডি ও ডাকযোগেও অভিযোগ জানানো যাবে। শ্রম-সংক্রান্ত অভিযোগ পর্যবেক্ষণ কমিটির সদস্যরা মালিক-শ্রমিক উভয়পক্ষেরই অভিযোগ শুনে সরকারকে অবহিত করবেন। যেসব দাবি পূরণ করা যায় তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।
এর আগে সকাল ৮টার দিকে আশুলিয়ার অধিকাংশ পোশাক কারখানার শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজে যোগ দেন। বেশিরভাগ কারখানা উৎপাদনে ফিরলেও গতকাল বন্ধ ছিল ২০টি কারখানা। এর মধ্যে শ্রম আইন ২০০৬-এর ১৩ (১) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে ১৮টি, বাকি দুটি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
সকালে আশুলিয়ার কাঠগড়া, জিরাবো, নরসিংহপুর ও জামগড়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন কারখানার সামনে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। সড়কেও টহল ছিল সেনাবাহিনী, বিজিবি ও র্যাব সদস্যদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল সকালে চার থেকে পাঁচটি কারখানায় শ্রমিকরা প্রবেশের পর বিভিন্ন দাবিতে উৎপাদন বন্ধ রাখেন। পরে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তারাও কাজে যোগ দিয়ে উৎপাদন শুরু করেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন বলেন, ‘গত শনিবার বিজিএমইএ উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনে সভা করে। ওই সভায় সব কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পাশাপাশি কোনো কারখানায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে মালিকপক্ষ চাইলে শ্রম আইন অনুযায়ী শুধু সেই কারখানা বন্ধ রাখতে পারবে বলে জানানো হয়। তবে আমরা জেনেছি, কয়েকটি কারখানা এখনো বন্ধ আছে। সমস্যা সমাধানে কারখানা খুলে শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। উভয়পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারলে সমাধান সম্ভব নয়।’
শিল্প পুলিশ-১-এর সুপার সারোয়ার আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার বন্ধ কারাখানার সংখ্যা ছিল ২১৯টি। শনিবার এসব কারখানার অধিকাংশই খুলে দেওয়া হয়েছে। আজও (গতকাল) বন্ধ থাকা আরও ২৯ কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়েছে। বর্তমানে শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় বন্ধ রয়েছে জেনারেশন নেক্সট, সান সোয়েটার, মাসকট ফ্যাশন ও পার্ল গার্মেন্টসসহ ১৮টি কারখানা।’
গাজীপুরে উৎপাদন স্বাভাবিক : পুরুষ শ্রমিক নিয়োগ ও বেকারদের চাকরির ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন দাবিতে গত দুই সপ্তাহ ধরে গাজীপুরে বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিক ও বহিরাগতদের বিক্ষোভ, কর্মবিরতি, সড়ক অবরোধ, ভাঙচুরসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছিল। তবে শনিবার থেকে পোশাক কারখানায় স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যা গতকালও অব্যাহত ছিল। তবে সকালে টঙ্গীতে কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা আগস্ট মাসের বেতন পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন।
কোনো কারখানায় বিক্ষোভ বা অস্থিরতা দেখা দিলে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে শনিবার বিজিএমইএর বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর গতকাল গাজীপুরের প্রায় সব পোশাক কারখানা পুরোদমে উৎপাদনে ফেরে। সকাল থেকে শ্রমিকদের বৃষ্টিতে ভিজে কারখানাগুলোয় কাজে যোগ দিতে দেখা গেছে। প্রতিটি কারখানার নিরাপত্তায় মোতায়েন ছিল শিল্প-পুলিশ। ছিল সেনাবাহিনী ও বিজিবির টহলও।
শুধু টঙ্গীতে মাইশা মিম অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা আগস্ট মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, শিং বাড়ি মোড়সংলগ্ন বাদাম ফিডার রোডের ওই কারখানাটি ছয় দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। কারখানার মালিকপক্ষ ভবন মালিকের কাছে কারখানাটি বিক্রি করে দিয়েছে বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লে গতকাল সকালে শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে। ২০০-৩০০ শ্রমিক কারখানার সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। বিষয়টি নিয়ে কারখানার মালিকপক্ষ ও ভবন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এ সময় রাস্তায় যানচলাচল বন্ধ হয়ে যানজটের সৃষ্টি হয়।
গাজীপুর শিল্প-পুলিশের সুপার মোহাম্মদ সারওয়ার বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কিছু কারখানা শ্রমিক আন্দোলন ও নিরাপত্তার স্বার্থে বন্ধ ছিল। তবে শনিবার সকাল থেকেই গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের প্রায় শতভাগ তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা খুলেছে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে বৈরী আবহাওয়াতেও শ্রমিকরা স্ব স্ব কারখানায় কাজে ফিরেছেন। আজও (গতকাল) তা অব্যাহত থাকে।’
মতামত লিখুন :