দেশে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্পনগরী ৭৯টি। এসব শিল্পনগরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ। দেশব্যাপী আঞ্চলিকভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পণ্য উৎপাদন ও রফতানি কার্যক্রম বাড়াতে স্থাপিত এসব শিল্পনগরীর মধ্যে কার্যকর মাত্র কয়েকটি। মোট কর্মসংস্থানের ৬০ শতাংশই তিনটি বিসিক নগরীতে। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে শিল্পনগরীগুলো কর্মসংস্থান ও উৎপাদন কার্যক্রমে পিছিয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মূলত ১৯৬০ সালেই বিসিকের কার্যক্রম শুরু হয় দেশব্যাপী। প্রথম কার্যক্রম শুরু হওয়া বিসিকের মধ্যে রয়েছে বরিশাল শিল্পনগরী। এরপর ১৯৬১ সালে রাজশাহী, কুমিল্লা, খুলনা, পিরোজপুর (স্বরূপকাঠি) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬২ সালে চালু হয় যশোর, দিনাজপুর, পাবনা, ফেনী বিসিক শিল্পনগরী। ১৯৬৩ সালে কুষ্টিয়া, ১৯৬৪ সালে রাজবাড়ী, বগুড়া ও টঙ্গী, ১৯৬৭ সালে রংপুর এবং ১৯৬৮ সালে ময়মনসিংহ বিসিকের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম দিককার টঙ্গী ছাড়া বাকি বিসিক শিল্পনগরীগুলো প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে।
বিসিকের এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ৭৯টি বিসিক শিল্পনগরীতে মোট কর্মসংস্থান হয়েছে ৬ লাখ ২৯ হাজার ৭০৬ জনের। এর মধ্যে ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় হোসিয়ারি বিসিকে কর্মসংস্থান হয়েছে সর্বোচ্চ ২ লাখ ২৯ জনের। এছাড়া দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চট্টগ্রামের কালুরঘাট শিল্পনগরীতে কর্মসংস্থান ৯৫ হাজার এবং তৃতীয় অবস্থানে থাকা টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫৪ হাজার। অর্থাৎ ৮০টি বিসিক শিল্পনগরীর মধ্যে তিনটিতে মোট কর্মসংস্থান দাঁড়াচ্ছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার জন, যা মোট কর্মসংস্থানের ৬০ শতাংশ।
নারায়ণগঞ্জের হোসিয়ারি শিল্পনগরীর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৫৮ দশমিক ৫২ একর জমির এ শিল্পনগরীতে শিল্প প্লটের সংখ্যা ৭৪১। বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৭৪০টি। বরাদ্দকৃত প্লটে ৪২৯টি শিল্প ইউনিটের মধ্যে ৪২০টি উৎপাদনরত, তিনটি বাস্তবায়নাধীন ও ছয়টি শিল্প ইউনিট রুগ্ণ অবস্থায় রয়েছে। এ শিল্পনগরীতে সর্বোচ্চ ২ লাখ ২৯ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। ১ লাখ ১৩ হাজার পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি কাজ করেন ১ লাখ ১৬ হাজার নারী শ্রমিক।
১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের কালুরঘাট বিসিক শিল্পনগরীতে ৭১টি শিল্প প্লটের মধ্যে ৩২টি শিল্প ইউনিট থাকলেও রুগ্ণ রয়েছে ছয়টি। কাজ করেন ১৫ হাজার শ্রমিক (৬ হাজার ৫০০ পুরুষ ও ৮ হাজার ৫০০ নারী শ্রমিক)। ১৯৯০ সালে একই স্থানে কালুরঘাট শিল্পনগরী সম্প্রসারণ করে ২৫৫ প্লটে ১২৭টি শিল্প ইউনিট স্থাপন করা হয়। ১৪টি শিল্প ইউনিট রুগ্ণ অবস্থায় থাকলেও ১১৩টি উৎপাদন রয়েছে। এখানে কাজ করেন ৮০ হাজার শ্রমিক, যার মধ্যে ৩০ হাজার ৯০০ পুরুষ ও ৪৯ হাজার ১০০ নারী শ্রমিক। টঙ্গীতে ২১৪ প্লটে ১৬৫টি শিল্প ইউনিট রয়েছে, যার মধ্যে ১৩৬টি উৎপাদন থাকলেও রুগ্ণ রয়েছে ২৫টি এবং বাস্তবায়নাধীন চারটি ইউনিট। এখানে ৫৪ হাজার শ্রমিকের মধ্যে নারী ৩৩ হাজার ও পুরুষ শ্রমিক ২১ হাজার।
বিসিকের মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) ড. মো. ফরহাদ আহম্মেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিসিক স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্প খাতের বিকাশ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও স্থানীয় পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে দেশব্যাপী শিল্পনগরী স্থাপনের কাজ করে যাচ্ছে। ষাটের দশকের আগে স্থাপন হওয়া বেশকিছু শিল্পনগরী সম্ভাবনাময় হলেও সেগুলো সফল না হওয়ার বিষয়টি সত্য। ওই সময় শিল্পনগরী স্থাপনের ক্ষেত্রে একাধিক সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। তাছাড়া রুগ্ণ ও পিছিয়ে থাকা শিল্পনগরীগুলোকে কার্যকর পর্যায়ে নিয়ে যেতে বিসিক একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে। বিসিকের বর্তমান কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বিসিক দেশের শিল্প খাতের বিকাশে হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।’
বিসিকের পরিকল্পনা ও গবেষণা বিভাগ বলছে, যন্ত্রপাতির সক্ষমতা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনে ব্যর্থতা, আর্থিক সংকট, কাঁচামালের সংকট, দক্ষ শ্রমিকের সংকট, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, বৃহৎ শিল্পের সঙ্গে পণ্য বিপণনে পিছিয়ে পড়া, অবকাঠামোগত সংকট, উৎপাদনরত শিল্প প্লটের ভূমিস্বল্পতা, পানি ও ইউটিলিটি সমস্যা, নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় ঝুঁকি, ক্ষুদ্র শিল্পগুলোর ঋণপ্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতার কারণে শিল্পনগরীগুলো পিছিয়ে পড়ছে। এছাড়া পুরনো শিল্পোদ্যোক্তাদের মৃত্যুর পর অংশীদারি সমস্যা, মামলা জটিলতা, মূলধন হারিয়ে ঋণখেলাপি হওয়ার কারণেও শিল্পনগরীগুলো সংকটের মধ্যে রয়েছে। এসব সংকট উত্তরণে বিসিকের পক্ষ থেকে একাধিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানের বিষয়টি সময়সাপেক্ষ হওয়ায় নতুন প্রস্তাবিত শিল্পনগরীগুলোকে সঠিক পন্থায় স্থাপনের দিকেই মনোযোগ বাড়াচ্ছে বিসিক।
বিসিকের পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) মো. হুমায়ুন কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিসিক দেশের শিল্প খাতের বিকাশে দশকের পর দশক ধরে অবদান রেখে যাচ্ছে। বিসিকের বিদ্যমান সমস্যাগুলো উত্তরণের জন্য এরই মধ্যে একাধিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’ সম্প্রতি বিসিকে যোগদান করায় এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
বিসিক-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশব্যাপী সড়ক, সেতুসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণকাজ হওয়ায় পুরনো ও রুগ্ণ শিল্পনগরীগুলোও নতুন করে সাজানো হচ্ছে। যার কারণে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামমুখী দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের কর্মমুখী মানুষ এসব শিল্পনগরীর মাধ্যমে দেশের শিল্প খাতের বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারবে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে বিসিক শিল্পনগরীগুলোয় মোট প্লটের সংখ্যা ১০ হাজার ৮৮৮। বরাদ্দ দেয়া ১০ হাজার ২৫৯টি প্লটে শিল্প ইউনিটের সংখ্যা ৫ হাজার ৮৯৯। যদিও উৎপাদনে রয়েছে ৪ হাজার ৫৭০টি কারখানা। এর মধ্যে ৯০১টি কারখানা রফতানিমুখী। প্রতি বছর শিল্পনগরীর কারখানাগুলো ১ হাজার ৩০০ থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার শুল্ককর পরিশোধ করে।
কৃতজ্ঞতাঃ বনিক বার্তা
মতামত লিখুন :