ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। উপসর্গগুলির মাঝে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি। দুই থেকে সাত দিনের মাঝে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষরী রূপ নিতে পারে যাকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলা হয়। এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কখনোবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে চললেও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে এই বছরে মৌসুমের আগে আগে সেটা প্রকট হয়ে উঠেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি অবনতি হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। তখন এই রোগটি ঢাকা ফিভার নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে রোগটির সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। বাংলাদেশে গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৬২ হাজার ৩৮২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। মৃত্যু হয়েছিল রেকর্ড ২৮১ জনের। সেই বছরেও জুলাই, অগাস্ট মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তার আগের বছরেও ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক ছিল। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল ২০১৯ সালে।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণঃ
১.জ্বর ১০২ থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে, ২.মাথাব্যথা, ৩.বমি, ৪.চোখের পেছনে ব্যথা, ৫.চামড়ায় লালচে দাগ (র্যাশ), ৬.শরীরে শীতলতা অনুভব করা, ৭.ক্ষুধা কমে যাওয়া, ৮.কোষ্ঠকাঠিন্য, ৯.স্বাদের পরিবর্তন, ১০.হৃদস্পন্দনের হার ও রক্তচাপ কমে যাওয়া এবং ১১.পেশিতে ব্যথা হওয়া।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে করনীয়ঃ
১. বাড়ির আশেপাশে ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখুন, ২.তিন দিনের বেশি জমে থাকা পানি ফেলে দিন, ৩. অব্যবহৃত পানির পাত্র উল্টে রাখুন, ৪. ঘুমানোর পূর্বে মশারী ভালোভাবে টানিয়ে নিন, ৫. শরীরে অনাবৃত স্থানে মশা প্রতিরোধী ক্রিম ব্যবহার করুন, ৬. যে কোন ধরনের জ্বরে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে করনীয়ঃ
১.পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিন ২. বেশি করে তরল খাবার গ্রহন করুন ৩. জ্বরের পরীক্ষা ও চিকিৎসার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন ৪. প্রয়োজনে হটলাইন ১৬২৬৩-তে ফোন করুন ৫. ডেঙ্গু সংক্রান্ত যে কোন তথ্যের জন্য প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন ৫. ফোনঃ ০২-২২২২৮৫৭৪৪
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৮৯৬ জন এবং মারা গেছেন একজন। আক্রান্তের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৪০৩ এবং ঢাকার বাইরে ৪৯৩ জন। শুক্রবার হওয়ায় অনেক হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য আসেনি। ২০ জুলাই ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন নয়জন। আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৭৫৫ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮৪৫ এবং ঢাকার বাইরের ৯১০ জন। ১৯ জুলাই মারা গেছেন ১৯ জন। এক দিনে এত মৃত্যু দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের ইতিহাসে রেকর্ড। আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৭৯২ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৯২২ এবং ঢাকার বাইরের ৮৭০ জন। ১৮ জুলাই ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৩ জন। আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৫৩৩ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৭৭৯ এবং ঢাকার বাইরের ৭৫৪ জন। ১৭ জুলাই ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন আটজন। আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৫৮৯ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮৪৭ এবং ঢাকার বাইরের ৭৪২ জন। ১৬ জুলাই মারা গেছেন ছয়জন। আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৪২৪ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৭৪১ এবং ঢাকার বাইরের ৬৮৩ জন। ১৫ জুলাই মারা গেছেন সাতজন। আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৬২৩ জন। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১ হাজার ১৬৮ এবং ঢাকার বাইরের ৪৫৫ জন।
এ পর্যন্ত ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ২৮ হাজার ৪৪৩ জনের মধ্যে ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। ডেঙ্গুতে প্রাণ হারানো ১৫৬ জনের মধ্যে ৮৯ জন পুরুষ এবং ৬৭ জন নারী। ডেঙ্গু আক্রান্তের বয়সভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৮-৪০ বছর বয়সী আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ হাজার ৩২৭ জন।
ঢাকার সরকারি হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১ হাজার ৮৪৮ জন, বেসরকারি হাসপাতালে রয়েছেন ১ হাজার ৭১২ জন। গতকাল রাজধানী বাদে ঢাকা বিভাগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৭১০ জন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ৬২৩, বরিশালে ৫৭৩, ময়মনসিংহে ১৬৫, সিলেটে ৬৮, রাজশাহীতে ৯৩, রংপুরে ৬৬ ও খুলনায় ২১৮ জন।
মাতিন কবির
স্টাফ রিপোর্টার
মতামত লিখুন :