বাংলাদেশে শ্রম অধিকার, কাজের পরিবেশ ও মান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। রানা প্লাজা ও তাজরীন দুর্ঘটনার পর জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে দেশটি এক প্রকার বার্তা দেয়। তবে এবার শ্রম অধিকার নিয়ে ঐকমত্যের পথে আসছে ঢাকা ও ওয়াশিংটন। সংশোধন করা হচ্ছে শ্রম আইন। শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে যে ৬-৭টি বিষয়ে মোটাদাগে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো দূর করা হবে। গতকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এতে বাংলাদেশের শ্রম অধিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
জানতে চাইলে মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র শন ম্যাকিনটোশ ই-মেইলে সমকালকে বলেন, বৈঠকে শ্রম বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাসহ শ্রম সংস্কার এবং বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সমকালকে বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে শ্রম অধিকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। সেই প্রস্তাবের বিষয়ে আলাপ করার জন্য বৈঠক হয়েছে।
বাংলাদেশের অন্যতম বড় বাণিজ্যিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের শ্রমিক সংগঠনের স্বাধীনতা এবং দরকষাকষির অধিকার, জোরপূর্বক শ্রম, শিশুশ্রম, কর্মস্থলের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে রয়েছে ওয়াশিংটনের উদ্বেগ। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের শ্রম আইন ও নীতি। আগামী দিনের ব্যবসা-বাণিজ্য নির্ভর করবে শ্রম আইন ও নীতির ওপর। এ বার্তা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে।
তৈরি পোশাক খাতে ভবন ও অগ্নিনিরাপত্তায় অগ্রগতি হলেও পুরো দেশের জন্য অভিন্ন শ্রম আইন, সংগঠন করার অধিকারকে বাধামুক্ত করা, সংগঠনের স্বাধীনতাসহ পেশার ক্ষেত্রে বৈষম্য, শ্রমিকের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, কর্মক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য শর্তাবলি, শ্রমিকের কর্মঘণ্টাসহ সার্বিক বিষয়গুলো নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে দেশটির। এ বিষয়গুলোসহ শ্রম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ দূর করতে চায় বাংলাদেশ। এ জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় (আইএলও) দেওয়া রোডম্যাপ বা পথনকশা অনুযায়ী শ্রম আইনের সংস্কার ও সংশোধন করার প্রস্তাব রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এ আইন সংশোধনও করবে বাংলাদেশ।
শ্রম আইনের সংশোধন নিয়ে জানতে চাইলে নাম না প্রকাশের শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে সংশোধনের প্রক্রিয়াতে রয়েছে। এ আইনের সংশোধন সংসদে চলমান বাজেট-পরবর্তী অধিবেশনে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আইনটি সংশোধন হলে শ্রম খাতের সংস্কারে অনেক এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। এর পর আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার যে সুপারিশ রয়েছে, সেই পর্যায়ে নিয়ে আসা হবে।
শ্রম আইনের সংশোধন কি সংসদের চলিত অধিবেশনে তোলা হবে– জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, দেখা যাক, প্রস্তুতি চলছে। এটি শ্রম মন্ত্রণালয়ের বিষয়। রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা– জানতে চাইলে তিনি বলেন, শ্রম বিষয় ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা হয়নি। রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে আলোচনা হয়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আগামী দিনের বাণিজ্য নির্ভর করবে বাংলাদেশের শ্রম আইন ও নীতির ওপর। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যত এগোবে, তার ওপর নির্ভর করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগোবে। তিনি বলেন, শ্রম আইনের সংশোধন হলেই আগামী জুলাই মাসের মাঝামাঝি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জিয়া এবং এর পরপরই অর্থনৈতিকবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজ ঢাকা সফর করবেন। জোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের অর্থনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। এতে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান। আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জিয়া শ্রম ও মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা করবেন। শ্রম ইউনিয়ন অনলাইনে নিবন্ধন বিষয়ে যে অগ্রগতি হয়েছে, তাকে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারির সফর বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, সফর বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। জুলাই মাসের ১১ তারিখের দিকে আন্ডার সেক্রেটারি ঢাকা সফর করবেন।
প্রতিবছর বাংলাদেশের শ্রমিকের অধিকার নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেয় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ প্রকাশিত শিশু ও জোরপূর্বক শ্রম নিয়ে প্রতিবেদন ২০২২ অনুযায়ী শ্রম খাতের সংস্কারে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে মাঝারি। তবে বাংলাদেশজুড়েই শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার। বাংলাদেশে শ্রমিক নির্যাতনের বিষয় ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর সামনে আসে। এর পর কিছু সংস্কার হলেও বর্তমানে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে জোরপূর্বক শ্রম, নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে কাজ করানো এবং ক্ষতিপূরণের অর্থ আটকে রাখার মতো ঘটনা ঘটছে।
কৃতজ্ঞতাঃ সমকাল
মতামত লিখুন :