শিল্পায়ন পরিকল্পনায় পানি, বায়ু, বন-বাস্তুসংস্থানসহ প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সংগঠনের ব্যবসায়ী নেতারা ও শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপের কর্ণধাররা।
শনিবার (২৯ এপ্রিল) সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে আরণ্যক ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘ন্যাচারাল রিসোর্সেস কনজারভেশন: স্কোপ অব প্রাইভেট সেক্টর এনগেজমেন্ট’ শীর্ষক কর্মশালায় তারা এ প্রতিশ্রুতি দেন। তবে পরিবেশ বান্ধব শিল্পায়নে সরকারি প্রণোদনা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এছাড়াও পরিবেশ বান্ধব কারখানায় উৎপাদিত তৈরি পোশাকের বাড়তি দাম দেয়ার জন্য বৈশ্বিক ক্রেতাদের প্রতি আহ্বান জানান উদ্যোক্তারা।
আরণ্যক ফাউন্ডেশনের ইউএসআইডি’র গ্রিন লাইফ প্রকল্পের আওতায় এ কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউএসআইডি বাংলাদেশের ইকোনমিক গ্রোথ অফিসের পরিচালক ড. মুহাম্মদ খান।
১৯৯০ থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় ইউএসআইডি কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা জরুরি।
ব্যক্তিখাতের অবদানের কথা স্মরণ করে তিনি জানান, বেসরকারি খাতের বিকাশের ফলেই বাংলাদেশের বিদেশি সাহায্য নির্ভরতা কমেছে। কর্মশালায় উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ ও তাদের মতামত দেশের জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
ড. মুহাম্মদ খান বলেন, পানি, বায়ু ও মাটি দূষণের কেন্দ্রে বনের অবক্ষয়। বন সংরক্ষণ করতে পারলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের অনেক সংকটের সমাধান মিলবে। এ লক্ষ্যে ব্যক্তিখাতের সক্রিয় উদ্যোগ আশা করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) ও বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক।
তিনি বলেন, পরিবেশ বান্ধব কারখানা স্থাপন করে আমরা সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছি। কিন্তু তাতে ব্যবসার মুনাফার ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বরং, উৎপাদনের খরচ বেড়েছে। যা ব্যবসাকে কঠিন করে তুলেছে।
তাই প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে উদ্যোক্তাদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনার দাবি করেন ফজলুল হক। একই সঙ্গে পরিবেশ বান্ধব কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের বাড়তি দাম দেয়ার ব্যাপারে ক্রেতাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্ততকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজীম। তিনি জানান, বর্তমানে পরিবেশ বান্ধব তৈরি পোশাকের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশ সবচেয়ে পছন্দের বাজার। বর্তমানে দেশে ১৯৫টি লিড সনদধারী পোশাক কারখানা রয়েছে।
প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা দেশের প্রত্যেকের দায়িত্ব বলে মন্তব্য করে মো. শহীদুল্লাহ আজীম বলেন, ‘পরবর্তী প্রজন্মকে একটি পরিচ্ছন্ন পৃথিবী উপহার দিতে বিজিএমইএ ফোর আর বা রিইউজ, রিডিউস, রিসাইকেল, রিকভার ধারণা বাস্তবায়ন ও তাপ ব্যবস্থাপনা নিয়ে করছে।’
গেস্ট অব অনারের বক্তব্যের বিএসআরএম’র হেড অব ব্র্যান্ডিং ফারাহ শাহরুখ রাজা জানান, তার প্রতিষ্ঠান পরিবেশের কথা চিন্তা করে পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার নকশা করেছেন। তারই অংশ হিসেবে বর্জ্যকে পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে। কাজেই অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিও একই আহ্বান জানান তিনি।
কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আরণ্যক ফাউন্ডেশনের হেড অব প্রোগ্রামস মাসুদ আলম খান। তিনি জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় প্রতিবছরই দেশের চারভাগের এক ভাগ প্লাবিত হয়। এই দুর্যোগের পরিমাণ ও তীব্রতা না কমাতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখা সম্ভব হবে না। এজন্য পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণে ব্যক্তি খাতের নিবিড় সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। বিশেষ করে ইকো ট্যুরিজম, স্থানীয় জনগোষ্ঠী ভিত্তিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্ব স্থাপন, সিএসআর কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানোর ব্যাপক সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
মূল প্রবন্ধের ওপর মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশে প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামীম আহমেদ জানান, বর্তমানে বাংলাদেশের প্লাস্টিক খাত কমলা শ্রেণিভুক্ত। এ খাতকে সবুজ শিল্পে পরিণত করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
রিসাইক্লিং করতে কয়েক ধাপে ভ্যাট দিতে হয় জানিয়ে এ কর প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে ওয়েল গ্রুপের সিইও সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘পরিবেশ বান্ধব শিল্পায়নে ব্যক্তিখাত প্রস্তুত। তবে এক্ষেত্রে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।’
পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে বলেই প্রকৃতি রুদ্ররূপ ধারণ করছে মন্তব্য করে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) পরিচালক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, তাই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় ব্যক্তিখাতকে আরও সক্রিয় করতে সরকারি নীতি সহায়তা প্রয়োজন।
এদিকে প্রকৃতি রক্ষায় বর্তমান প্রজন্মকেও সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন এফবিসিসিআই’র পরিচালক ও ওয়েন্ড সভাপতি ড. নাদিয়া বিনতে আমিন।
আর অপরিকল্পিত পর্যটন থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে এফবিসিসিআই’র পরিচারক এম জি আর নাসির মজুমদার সরকারকে নীতিমালা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করার তাগিদ দেন। এছাড়াও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উদ্যোক্তাদের করছাড় দেয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।
গত বছর বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ প্লাস্টিক ফুটপ্রিন্ট তুলে আনা হয়েছে জানিয়ে ইউনিলিভারের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শামীমা আক্তার বলেন, পরিবেশ বান্ধব প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন করতে যেসব বাড়তি খরচ হয়, তা শুল্কমুক্ত নয়। অন্য কোনো প্রণোদনাও নেই।
তাই পরিবেশ বান্ধব পণ্য উৎপাদনে সরকারকে সহায়ক নীতি প্রণয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো’র সাসটেইন্যাবিলিটি অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র ম্যানেজার আহমেদ রায়হান আহসানুল্লাহ জানান, বর্তমানে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানর সঙ্গে অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে বৃক্ষায়ন, সুপেয় পানি সরবরাহসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছে তার প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া কর্মশালায় অন্যান্যদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন মাটি অর্গানিকস লিমিটেড এর এমডি মো. খায়রুল আলম, রিসাইক্লিং জার লিমিটেডের সিইও জিয়াউর রহমান, সিটি গ্রুপের টি এস্টেটের জেনারেল ম্যানেজার সাজাদ সারওয়ার ও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশেনের হেড অব প্রজেক্ট অ্যান্ড প্রোগ্রাম রেহানা আক্তার রুমা।
কৃতজ্ঞতাঃ সময় নিউজ
মতামত লিখুন :