প্রতিবছর মে দিবস এলেই আলোচনা ওঠে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে। নানা দাবি ওঠে সভা সেমিনারে। দেওয়া হয় বিভিন্ন পরামর্শ। সরকারের পক্ষ থেকেও জানানো হয় বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণের কথা। এভাবেই আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস আসে আর যায়, কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না শ্রমিকের। মেলে না আইন অনুযায়ী শতভাগ অধিকার। কথার কথায় পরিণত হয়ে যায় পেশাগত সুরক্ষার বিষয়টি। নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়েই ফের শুরু হয় জীবনযুদ্ধ। এভাবেই কাটছে বছরের পর বছর। এ দিনটি ঘিরে শিশুশ্রম বন্ধের প্রতিশ্রিুতি এক যুগের বেশি সময় ধরে সব মহল থেকে এলেও তা কার্যকর হয়নি।
শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, গত এক দশকে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। যাদের পরিবারকে অনিশ্চয়তায় দিন কাটাতে হচ্ছে। প্রতিবছর গড়ে এক হাজার শ্রমিকের মৃত্যু হয় কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত কারণে।
দেশে রানা প্লাজা, তাজরীন গার্মেন্টস, রূপগঞ্জসহ অনেক দুর্ঘটনায় অসংখ্য শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। জীবন্ত পুড়ে কয়লা হয়েছেন। সেই সঙ্গে হারিয়েছেন আশা-স্বপ্ন। অনেক পরিবার হারিয়েছে তাদের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এতকিছুর পরও সামান্য ক্ষতিপূরণে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। অনেক সময় সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলেও মালিক-শ্রমিক সমন্বয়হীনতায় সব বৃথা যায় বলেও অভিযোগ অধিকার কর্মীদের।
তারা বলছেন, দেশে কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি কমছেই না। প্রতিবছর অনেক শ্রমিক আহত বা পঙ্গুত্ববরণ করছেন। প্রতিদিনই শ্রমিকদের জীবনহানি হচ্ছে। শতভাগ অধিকার উপভোগ করা তো দূরের কথা চাকরিচ্যুত হলেও পান না বিচার। তবে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিতে শ্রম আইন সংশোধনে কাজ করছে সরকার। শ্রমিকদের সার্বজনীন পেনশন চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইপিজেড এলাকায় শ্রমিকদের জন্য শ্রম বিধিমালা কার্যকর করা হয়েছে। হেল্পলাইন চালু করা হয়েছে। শ্রম পরিদর্শনের মান বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
আইন সংশোধনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা শ্রম বিধিমালা-২০১৫ কে যুগোপযোগী করে ২০২২ সালে সংশোধন করেছি। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে সংশোধন করেছি। শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ শ্রম আইন আবারও সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি। সংশোধিত এই শ্রম আইন অর্থনৈতিক অঞ্চলেও কার্যকর হবে।’ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণায় বলছে, ইপিজেড বা জোনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শ্রমিক নিয়োগ, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক, সর্বনিম্ন মজুরির হার নির্ধারণ, মজুরি পরিশোধ, কর্মস্থলে দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকের জখমের জন্য ক্ষতিপূরণ, শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দেশে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আইন থাকার পরও করোনা মহামারিতে অসংখ্য শ্রমিক হারিয়েছেন আয়ের প্রধান উৎস। অফিসে (ফরমাল সেক্টর) চাকরি করেন, এমন ১৩ ভাগ মানুষ মহামারিকালে কাজ হারিয়েছেন। চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই, এমন মানুষের সংখ্যা আরও বেশি। আর করোনাকালে ২৫ ভাগ চাকরিজীবীর বেতন কমে গেছে।
অন্যদিকে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, করোনার মধ্যে ১ লাখ ১০ হাজারের বেশি পোশাকশ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। বাংলাদেশ অক্যুপেশনাল সেইফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (ওশি) ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছেন ১১৯৫ জন শ্রমিক। এরমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৯৬৭ জন এবং আহত হয়েছেন ২২৮ জন। গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে কর্মক্ষেত্রে হতাহতের সংখ্যা ছিল ১০৮৯ জন।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ২৪৬ জন শ্রমিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ৯৪৯ জন শ্রমিক হতাহত হয়েছেন। এরমধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে মারা গেছেন ১৫২ জন এবং আহত হয়েছেন ৯৪ জন। আর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ৮১৫ জনের মৃত্যু এবং আহত হয়েছেন ১৩৪ জন। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত মিলিয়ে মারা যাওয়া ৯৬৭ জনের মধ্যে নারী শ্রমিক ২৪ জন এবং পুরুষ শ্রমিক ৯৪৩ জন। আর এ দুই খাতে আহত ২২৮ জনের মধ্যে নারী শ্রমিক ছিলেন ২৮ জন এবং পুরুষ শ্রমিক ছিলেন ১৯০ জন।
ওশি ফাউন্ডেশন জানায়, ২০২২ সালে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যে ৯৬৭ জন শ্রমিক নিহত হন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক মারা যান পরিবহন খাতে। বছরজুড়ে এ খাতে মোট হতাহতের সংখ্যা ৪৭৬ জন, যার মধ্যে ৪২৫ জন নিহত আর ৫১ জন আহত হয়েছেন। যা মোট হতাহতের ৪০ শতাংশ।
পরিবহন খাতের পরেই রয়েছে সেবামূলক খাত। এ খাতে মোট ২৭০ জন শ্রমিক হতাহতের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ২১১ জন মারা গেছেন আর ৫৯ জন আহত হয়েছেন। যা মোট হতাহতের ২৩ শতাংশ। এই সেবামূলক খাতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ওয়ার্কশপ, গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী প্রভৃতি।
তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে ম্যানুফ্যাকচারিং। এ খাতে মোট হতাহতের সংখ্যা ১০০ জন। যার ৬৭ জন নিহত এবং ৩৩ জন আহত হয়েছেন। যা মোট হতাহতের ১৮ শতাংশ।
আর কৃষি খাতে মোট ১৩৯ জন শ্রমিক হতাহত হয়েছেন। যার মধ্যে ১২৪ জন মারা গেছেন আর ১৫ জন আহত হয়েছেন। যা মোট হতাহতের ১২ শতাংশ। ফসল উৎপাদন কর্মী, জেলে, চা শ্রমিক, গরু ও মুরগির খামারের শ্রমিক এ খাতের আওতাভুক্ত।
নির্মাণ খাতে বছরজুড়ে ১৩৪ জন শ্রমিক বিভিন্ন দুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছেন, যার মধ্যে ১০৫ জন নিহত এবং ২৯ জন আহত হয়েছেন। যা মোট হতাহতের ১১ শতাংশ।
এ বছর তৈরি পোশাক শিল্প খাতে মোট ৫৪ জন শ্রমিক হতাহতের শিকার হন। এর মধ্যে ২৮ জন মারা যান এবং ২৬ জন আহত হন। যা মোট হতাহতের ৪ শতাংশ। একই সময়ের মধ্যে জাহাজ ভাঙা শিল্পে হতাহতের সংখ্যা ২২ জন, যার মধ্যে নিহত ৭ জন এবং আহত হন ১৫ জন। যা মোট হতাহতের ২ শতাংশ।
ওশি ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা যায়, গত এক দশকে (২০১৩-২২) মোট ১৫ হাজার ২৫৯ জন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে হতাহতের শিকার হন। এর মধ্যে ৯ হাজার ৫৫৮ জন নিহত এবং ৫ হাজার ৭০১ জন আহত হন। তবে ২০২০ সালে করোনা অভিঘাতের সময় এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি ওসি ফাউন্ডেশন।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ঢাকা টাইমসকে আরও বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যাপী সাম্প্রতিক সময়ে কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা বিধি পালন ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণ অত্যন্ত গরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণ এখন কারখানা মালিকপক্ষের জন্য দায়বদ্ধতায় পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানের মালিক, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, শ্রমিক সংগঠন, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সম্মিলিতভাবে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং কর্মক্ষেত্রে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
শিশু শ্রমিক ১৭ লাখ
এদিকে শিশুশ্রম নিয়ে সম্প্রতি কথা ওঠে জাতীয় সংসদেও। গত ২৫ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশনে সরকারি দলের সংসদ সদ্য হাবিব হাসানের প্রশ্নের জবাবে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান সংসদে বলেন, দেশে শ্রমে নিয়োজিত শিশুর মোট সংখ্যা ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন বা ১৭ লাখ। এরমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ১ দশমিক ২ মিলিয়ন।
প্রসঙ্গত, শ্রমিকদের অধিকার ও দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মে দিবস পালিত হয়। স্বাধীনতার পর মে দিবস রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে মহান মে দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে মে দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে দেশে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে মে দিবস।
কৃতজ্ঞতাঃ ঢাকা টাইমস
মতামত লিখুন :