Logo

শিশুদের ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া সময়ের দাবী

RMG Times
সোমবার, এপ্রিল ২৪, ২০২৩
  • শেয়ার করুন

আচ্ছা বলুন তো একজন শিশু তার ভালোমন্দের কি বোঝে? কিসে তার ভাল কিসে তার মন্দ আসলেই কি সে বুঝতে পারে? নাকি আমরাই তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেই ভালমন্দের সংজ্ঞাটা তাদের বুঝতে সহায়তা করি। আর তাই একটি শিশু সাবালক না হওয়া পর্যন্ত জীবনের নানা বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তার অভিভাবকের মুখাপেক্ষী থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের সঠিক নির্দেশনা যেমন তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করবে ঠিক তেমনি আমাদের একটু ভুল নির্দেশনা তার চিন্তাচেতনায় একটি বড় ধরণের কুপ্রভাব ফেলতে পারে, এক্ষেত্রে নিশ্চয় কেউ দ্বিমত হবেন না। কত বছর পর্যন্ত একজন মানব সন্তানকে একজন শিশু হিসাবে ধরা যায়। আমাদের দেশে ভোটার হতে বা প্রাপ্ত বয়স্ক হতে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়া জরুরী, সেক্ষেত্রে ১৮ বছরের নীচে যারা তারা সবাই শিশু। তবে বয়ঃসন্ধিকাল কাল থেকে পূর্ণ ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তাদেরকে আমরা কিশোর হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকি। বলতে পারেন যে কিনা ১৩ বছর বয়সে প্রেম করতে পারে কিংবা  প্রেম পত্র লিখতে পারে তাকে কিভাবে শিশু বলা যায়? আমি বলি পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান না আসা পর্যন্ত এসবকিছুই ভালবাসার মধ্যে পরেনা। ভালোলাগা বলা যেতে পারে। আর বয়ঃসন্ধিকালে প্রকৃতিগতভাবেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি একটা আকর্ষণ থাকবেই। সেসব ভিন্ন কথা আর আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তুও তা নয়। আমার কাছে যেটা উদ্বেগের বিষয় তা হল এই শিশুরা কেন, কিভাবে বিভিন্ন সামাজিক অপরাধে জড়াচ্ছে তা নিয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করা।

একদিন রামপুরা থেকে মৌচাকের রাস্তায় হাঁটছি, দেখলাম আনুমানিক ৬ থেকে ১২ বছর বয়সের কজন ছেলেমেয়ে একত্রিত হয়েছে (যাদেরকে আমরা টোকাই বলে থাকি) তাদের মধ্যে ৩/৪ জনের হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ! সেই ব্যাগে মুখ লাগিয়ে তারা জোরে জোরে মুখ দিয়ে টানছে! আমার খুব কৌতূহল হল আমি পাশের এক দোকানদার ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন “আর  বলেন না ভাই ওরা সব জুতা ঠিক করতে যে গাম/ সলিউশন ব্যবহার করা হয় তা ঐ প্লাস্টিকের ব্যাগে ভড়ে টান দিচ্ছে, এটাও একপ্রকারের নেশা” আমি জিজ্ঞাসা করলাম “ আপনারা কিছু বলেন না কেন, এভাবে খোলা রাস্তায় নেশা করছে” তিনি বললেন, “ভাই এরা পারেনা এমন কাজ নেই, এই জামানায় কে অন্যের ভাল করতে গিয়ে নিজের ক্ষতি টেনে আনবে বলেন? আর যারা নিজেই নিজের ভালমন্দ বোঝেনা তাদের কি বুঝাবেন বলেন?” আমি বললাম “ ভাই এরা তো শিশু!” তিনি বললেন, “ আর সে কথা বলেন না ভাই, যাদেরকে মিছিল মিটিং এ ব্যবহার করা হয়, যারা এভাবে নেশা করে বিভিন্ন সামাজিক অপরাধে জড়ায় তাদের শিশু বলেন কিভাবে?” ভদ্রলোক উল্টো আমাকে এমন একটি প্রশ্ন করে ফেললেন যা আমাকে সত্যিই ভাবিয়ে তুলল। শিশুর সংজ্ঞা নিয়ে আবার ভাবিয়ে তুলল! এদের বেশীরভাগই ভেঙ্গে যাওয়া সংসারের অংশ যাদের কারও হয় বাবা আছে মা ছেড়ে চলে গেছে অথবা মা আছে বাবা ছেড়ে চলে গেছে, রাস্তায় ফুটপাতে এরা মানুষ হয়। যাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়না নিশ্চয় তাদের সমাজের, রাষ্ট্রের প্রতি একটি ক্ষোভ জন্মায় আর একসময় তারাই হয়ে ওঠে নিষ্ঠুর পাষাণ। গতবার আমাদের শহরে গিয়ে শুনলাম মিছিলের জন্য বস্তির শিশু কিশোরদের বয়স ও গঠন হিসাবে ৪০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত রেট আছে! যার যেমন বাজেট সেই হিসাবে লোক নেয়। কেউ কি আর নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে যাবে (শোনা কথা কিন্তু কথাটা আমার কাছে অযৌক্তিক  মনে হয়নি)।

হাতিরঝিলে প্রায়ই দেখা যায় একদল ছেলে মোটর সাইকেল প্রতিযোগিতা করছে । সাপ যেমন এঁকেবেঁকে চলে ঠিক সেভাবে বেপরোয়া তাদের চালনা! এমনকি সেই মোটরসাইকেলে ৩ জন যাত্রী থাকে যাদের কারোরই হেলমেট থাকেনা। আমার সন্দেহ হয় তারা হেলমেট শব্দটি উচ্চারণ করতে পারে কিনা। একদিন সাহস করে একজন কে জিজ্ঞাসা করলাম ভাই হেলমেট পরেন না কেন(অবশ্য প্রশ্ন জিজ্ঞাসার পর তার হাবভাব দেখে কিঞ্চিৎ ভয় যে লাগেনি তা নয়)। ছেলেটি বলল হেমলেট পরলে মাথা গরম হয় তাই পরেনা। “হেমলেট” শব্দটি উচ্চারণ করার সাথে সাথে আমার সেক্সপিয়ারের কথা বড্ড মনে পড়লো। ভাগ্যিস অমলেট বলেনি তাহলেতো লোভে জিহ্বায় পানি চলে আসতো, আসবেনা কেন সেই সময় একটা ক্ষুধা ক্ষুধা ভাব ছিল আমার! যাই হোক আসল কথায় আসি এদের কাউকে দেখেই মনে হয়না যে তারা সচ্ছল পরিবারের সন্তান আর তাদের মোটরসাইকেল গুলো তাদের অভিভাবকরা কিনে দিয়েছে! ২/৩ লক্ষ টাকা দামের একটি বাইক কি ধরণের বেশধারী মানুষের থাকার কথা তাতো বোঝা যায় নাকি। তাহলে এরা মোটরসাইকেল পেল কোথায় ? যদি কিনেও থাকে এদের আয়ের উৎস কি বলতে পারেন?

বললাম সমাজের একশ্রেণীর শিশুদের কথা এবার বলি যে শিশুদের সচ্ছল পরিবার রয়েছে তাদের কথা।

তাদের মনে ঢুকছে বিষ প্রতিটি ক্ষণে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে । পরিবার, সমাজ কোনটাই বাকি নেই, বিষ শুধুই বিষ। ৮ থেকে ১৬ বছরের শিশুকে যখন তার অভিভাবক বলছে অমুকের সাথে মেলামেশা করোনা , অমুকের সাথে খেলাধুলা করোনা, অমুক জায়গায় যাওয়া যাবেনা, অমুক অনুষ্ঠান শোনা যাবেনা, এই করা যাবেনা, ঐ করা যাবেনা! তখন সে শিশুর মনে ঘোরে নানা প্রশ্ন, পারেনা আদেশ দাতাকে জিজ্ঞাসা করতে, পারেনা অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করতে, কিন্তু মনে মনে ঠিকই উত্তর খুঁজতে থাকে কেন করা যাবেনা? কেন মেশা যাবেনা? কেন যাওয়া যাবেনা? কেন দেখা যাবেনা? অতঃপর প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে আপন মনেই উত্তর খুঁজতে থাকে যা মূলক না অমূলক একটা শিশুর পক্ষ্যে তা বিচার করা কি সম্ভব?

আমরা ধর্মের কথা বলি, সমাজের বিভিন্ন স্তরে এই ধর্ম নিয়েই শিশুদের মনে যে বিষ ঢুকে যায় তা আমৃত্যু থেকে যায়। এর জন্য দায়ী কে অথবা কারা? আমরা নিশ্চয়! পৃথিবীতে এমন কোন ধর্ম আছে কি যা কিনা অন্য ধর্মকে অসম্মান করার কথা বলে? অন্য কোন গোষ্ঠীর লোককে ঘৃণা করতে বলে? ধর্মের নামে নাশকতা করতে বলে? উত্তর আসবে না নেই। তবে আমরা সবাই কেন ছোট বেলা থেকে শিশুদের মধ্যে এই ভেদাভেদ এই ঘৃণা ঢুকিয়ে দেই বলতে পারেন? আমি আমার শিশুকে হিন্দি কার্টুন দেখতে নিষেধ করতে পারি কিন্তু কেন নিষেধ করছি আছে কি তার কোন ব্যাখ্যা? বলতে পারেন সেসব দুষ্টুমিতে ভরা আর শিশুরা হিন্দি ভাসা শিখছে, তাদের পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে, তাদের মাথায় সারাক্ষণ কার্টুন ঘুরপাক খাচ্ছে! তাহলে এই কার্টুন বাংলাদেশে চালু হল কেন? কে চালু করলো? যখন চালু করা হল তখন কেউ এগিয়ে এলো না কেন? আমরা আমাদের সংস্কৃতির আবহে শিশুদের জন্য কি করছি? অভিনব কি তৈরি করছি যা থেকে তারা শিখবে, তাদের বিনোদনও হবে? জানামতে আজ পর্যন্ত যতজন কিছু করার উদ্যোগ নিয়েছে কখনো অর্থের অভাবে কখনো অনুষ্ঠান চলছেনা এই অজুহাতে তাদের সেই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশে কি একজন ট্যালেন্টও নেই যে ডরিমন, সিঞ্চন এর থেকে ভাল মত কার্টুন নির্মাণ করতে পারে? নেই কি এমন কেউ যে কার্টুনের মাধ্যমে শিক্ষণীয় অনেক কিছু শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে। যে মানুষটি পড়তে জানেনা তাকে বোঝানোর ভাসা যেমন একটি ছবি হতে পারে ঠিক অবুঝ শিশুকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে এমন সৃষ্টিশীল কিছু করতে আমরা কি পারিনা ? নাকি পেরেও করছিনা। দূরন্ত টিভি অবশ্য বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে কিন্তু আমরা কজন বাবা মা তার খোঁজ রাখি কিংবা আমাদের শিশুদের তা দেখতে উৎসাহিত করি। দেশীয় শিল্পকে এভাবেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত করি আর প্রভাব পরে আমাদের শিশুদের উপর।

ঢাকা শহরে আমার মত যারা সন্তানের বাবারা আছেন তারা কতটাই না আফসোস করি মাঝে মাঝে। আমরা এসেছি মফঃস্বল থেকে সেখানে খেলার জন্য বিস্তৃত মাঠ, ঘুম থেকে উঠে সবুজ ঘাসে খালি পায়ে হাটা, প্রতিবেশী অন্যান্য শিশুদের সাথে গোল্লা ছুট , বৌছি, দাড়িয়াবান্ধা , ডাংগুলি, ক্রিকেট, ফুটবল আরও কত খেলা আর সন্ধ্যা হলে সাথে সাথে এক দৌড়ে ঘর। অতঃপর মাইকের মত উচ্চস্বরে পড়াশুনা যেন অভিভাবকদের জানান দিচ্ছি, এইতো আমি পড়ছি ! কত মজা, আহা! আর আমাদের শিশুরা ঢাকার মত যান্ত্রিক নগরে চতুর্থ তলায় অবস্থিত এক সো কল্ড ফ্ল্যাট থেকে বিষণ্ণ বদনে চেয়ে থাকে রাস্তায় কে আসে কে যায়! সকাল টা শুরু হয় স্কুল থেকে ৫ থেকে ১০ কেজী একটি বইয়ের বস্তা নিয়ে শিশু চলেছে স্কুল। স্কুলে শুরু হল ইয়েস মিস, স্ট্যান্ড আপ, সিট ডাউন আর হোম ওয়ার্কের খাতায় একগাদা ঘরের কাজ! নে বাবা কাজ করে খা। বাসায় এসে শুধু একটু নাস্তা করে হাতমুখ ধুয়ে শুরু হল পড়ার যুদ্ধ মায়েতে , হোম টিচারে, খাতাতে, বইয়েতে একাকার! অতঃপর ৩/৪ ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রমে বাছা আমার ক্লান্ত শরীরে শেষ করে পরের দিনের পাঠ। কিসের খেলা কিসের কি? আছে কিছু আশেপাশে? চারিদিকে তো শুধু অট্টালিকারা অট্টহাসি দিচ্ছে। বিনোদন বলতে যে শিশুর একমাত্র সম্বল হয় কার্টুন। সেই কার্টুন থেকে সে মিথ্যে বলা শিখছে, ভিনদেশীয় ভাসা শিখছে, ছলচাতুরী শিখছে! আমরা অভিভাবকরা তাদের সময় দিতে পারিনা তাই হয়ত অনেক সময় তাদের সেই অভাব পূরণ করার জন্য তাদের হাতে তুলে দেই দামী ট্যাব , মোবাইল, একসময় মোটরসাইকেল। আর সর্বনাশের শুরু সেখানেই। একটি যন্ত্র কি কখনো অভিভাবকের স্থান দখল করতে পারে? একটি শিশুর ক্ষেত্রে তার পরিবার থেকেই সামাজিকতার প্রথম পাঠ শুরু হয় আর এই আমরাই যখন তাদেরকে সময় না দিয়ে একটি গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলি , তাদের সঠিক ব্যাখ্যা না দিয়ে শুধু না শব্দটি বলি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি এটি কখনোই মঙ্গলজনক নয়। অনেকের মাঝে থেকেও তাদের একাকীত্ব থেকেই যায় তাই যৌথ পরিবারে থেকে আমরা মানবিক যে গুণাবলিগুলো পেয়েছি, যেমনঃ দয়া মায়া, ভালবাসা ইত্যাদি তাদের মধ্যে থাকবেনা এটাই স্বাভাবিক। হয়ত বলতে পারেন ঢাকা শহরে যৌথ পরিবার অসম্ভব একটা ব্যাপার,  এক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই কিন্তু আপনার আমার শিশুকে আমাদের  মত গড়ে তুলতে হলে তাকে তো সময় দিতেই হবে। আপনি সময় না দিলে তারা শিখবে কোথা থেকে এটাতো পাঠ্যপুস্তক পড়ে রপ্ত করার বিষয় নয়। আর যে পথশিশুদের কথা বললাম তাদের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু দায়িত্ব বর্তায় অনেক এনজিও এ বিষয়ে কাজ করছে তাদেরকে সাধুবাদ জানাই কিন্তু শুধু কয়েকটি এনজিও কি পারবে সব শিশুকে কভার করতে? আমাদের মনে রাখতে হবে মাদক নিরাময় কেন্দ্র  কিংবা কিশোর সংশোধন কেন্দ্র করার চেয়ে যে কারণে একটি শিশু একটি কিশোর মাদক সেবন করছে, সামাজিক অপরাধ করছে কিংবা যে সময় থেকে করছে সেই কারণ নিয়ে সময়ের কাজ সময়ে না করলে এ অবক্ষয় রোধ করার সাধ্য আছে কার।