ঈদের আগেই তৈরি পোশাকসহ শিল্প খাতের শ্রমিকদের বোনাস ও বেতন-ভাতা পরিশোধের নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। এর ভিত্তিতে গতকাল বিকাল ৫টা পর্যন্ত দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোর প্রায় ৪০ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের ঈদের বোনাস পরিশোধ করেছে। এছাড়া শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ও পুরনো বকেয়া পাওনা পরিশোধের কার্যক্রমও চলমান।
এ বছর ঈদের আগে বেতন-ভাতা ও বোনাস পরিশোধ নিয়ে শিল্পাঞ্চলগুলোয় অপ্রীতিকর পরিস্থিতির আশঙ্কায় ছিলেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাদের বক্তব্য হলো গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই সাত শিল্প এলাকার রফতানিমুখী কারখানাগুলো ক্রয়াদেশ সংকটে রয়েছে। অনেক কারখানা কাজের অভাবে বন্ধও হয়েছে। শুধু ২০২২ সালেই বন্ধ হয়েছে ৫১০টি কারখানা। আর চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বন্ধ হয়েছে ৯৭টি। এ পরিস্থিতিতে তারল্য সংকটে ভুগছে অনেক কারখানা। তবে এত বিরূপ পরিস্থিতিতেও এখন পর্যন্ত শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় বড় ধরনের কোনো অস্থিরতা দেখা দেয়নি।
এর আগে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে ৫ এপ্রিল এক সভার পর বলা হয়েছিল, সব খাতের কারখানা শ্রমিকদের ঈদের বোনাস, চলতি মাসের অন্তত সাতদিনের বেতন ও যাবতীয় বকেয়া ঈদের ছুটির আগেই পরিশোধ করতে হবে। দেশে শিল্প অধ্যুষিত অঞ্চল সাতটি—আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, খুলনা ও সিলেট। এসব এলাকায় মোট কারখানা আছে ৯ হাজার ৬১৬টি। এলাকাগুলোর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, শিল্পাঞ্চলগুলোর ১ হাজার ২৮৪টি কারখানা পহেলা বৈশাখের ছুটির আগে ১৩ এপ্রিলের মধ্যেই বোনাস পরিশোধ করে দেয়। এরপর গতকাল বিকাল ৫টা পর্যন্ত মোট বোনাস পরিশোধকারী কারখানার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮২০-এ। সে অনুযায়ী, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত শিল্প এলাকার ৩৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ কারখানা শ্রমিকের বোনাস পরিশোধ করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আইন অনুযায়ী মাসের প্রথম ১০ দিনের মধ্যে আগের মাসের বেতন পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদিও তা কখনই যথাযথভাবে পরিপালন হতে দেখা যায় না। ঈদের আগে শিল্প মালিকরা সাধারণত ছুটির আগের দিন পর্যন্ত বেতন-ভাতা ও বোনাস পরিশোধ করেন। এ বছরের চিত্রটিও একই রকম।
রফতানিমুখী শিল্প-কারখানার বড় অংশই তৈরি পোশাক খাতের। এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শ্রমিকের বেতন-ভাতা ও বোনাস পরিস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছে বিজিএমইএ। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় খোলা হয়েছে ক্রাইসিস কন্ট্রোল রুম। বর্তমানে রফতানি আদেশের স্বল্পতা রয়েছে। তার পরও সরকারের সহযোগিতায় বেতন-ভাতা ও বোনাস পরিশোধ হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বিজিএমইএর সদস্য ৯২ শতাংশেরও বেশি কারখানায় বেতন পরিশোধ হয়েছে। বোনাস পরিশোধ হয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ কারখানায়। দুই-তিন দিনের মধ্যে আশা করছি সব কারখানায় পরিশোধ শেষ হবে।’
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, শিল্প অধ্যুষিত সাত এলাকায় বিজিএমইএর সদস্য কারখানা আছে ১ হাজার ৬৩১টি। এর মধ্যে গতকাল বিকাল ৫টা পর্যন্ত ৬৪৯টি কারখানা বোনাস পরিশোধ করেছে। বাকি রয়েছে ৯৮২টি বা ৬০ দশমিক ২১ শতাংশ কারখানায়।
সাত শিল্প এলাকায় নিটওয়্যার খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএর সদস্য কারখানা রয়েছে ৭০০টি। এর মধ্যে বোনাস পরিশোধ হয়েছে ৩৩৪টি কারখানার। পরিশোধ হয়নি এমন কারখানা ৩৬৬টি বা ৫২ দশমিক ২৯ শতাংশ।
এলাকাগুলোয় বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সদস্য কারখানা আছে ৩৮৫টি। এর মধ্যে বোনাস পরিশোধ হয়েছে ১৪৫ কারখানার। পরিশোধ হয়নি এমন ২১৩টি বা ৫৯ দশমিক ৫০ শতাংশ কারখানায়।
বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) আওতাভুক্ত ৩৪৫ কারখানার মধ্যে গতকাল বিকাল ৫টা পর্যন্ত বোনাস পরিশোধ করেছে ২৪৩টি। বাকি ১০২ বা ২৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ কারখানায় পরিশোধ হয়নি।
এসব এলাকায় পাটকল আছে মোট ৮৩টি। এর মধ্যে বোনাস পরিশোধ হয়েছে ২৯টিতে। বাকি ৫৪টি বা ৬৫ শতাংশ কারখানায় বোনাস পরিশোধ হয়নি।
শিল্প এলাকাগুলোয় কোনো সংগঠন বা কর্তৃপক্ষের আওতাহীন কারখানা আছে ৬ হাজার ৪৯৯টি। এর মধ্যে বোনাস পরিশোধ হয়েছে ২ হাজার ৪২০টিতে। বাকি ৪ হাজার ৭৯ বা ৬২ দশমিক ৭৬ শতাংশ কারখানায় গতকাল বিকাল ৫টা পর্যন্ত বোনাস পরিশোধ হয়নি।
বেতন-ভাতা পরিশোধের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গতকাল বিকাল ৫টা পর্যন্ত সাত শিল্প এলাকার ৯ হাজার ৬১৬টি কারখানার মধ্যে ৭ হাজার ৬৯৮টিতে মার্চের বেতন-ভাতা পরিশোধ হয়েছে। বেতন বকেয়া রয়েছে ১ হাজার ৯১৮টি বা ১৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ কারখানার।
সরকার-মালিক-শ্রমিক সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (আরএমজি টিসিসি) ১৪তম সভা অনুষ্ঠিত হয় ৫ এপ্রিল। সভা শেষে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান ঈদের ছুটির আগেই বোনাস এবং কোনো কারখানায় মার্চের বেতন বকেয়া থাকলে তা পরিশোধ করে দেয়ার জন্য মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘শ্রমিকরা যাতে ভালোভাবে ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে পারেন, সেজন্য মালিকরা ঈদের আগেই বোনাস দেবেন। নিয়ম অনুযায়ী এপ্রিলের সাত কর্মদিবসের বেতন পরিশোধ করবেন। তবে দুই-একটি কারখানার মার্চের বেতন যদি বকেয়া থাকে, সেটিও অবশ্যই ঈদের ছুটির আগে পরিশোধ করবেন।’
ঈদের ছুটির বিষয়ে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারি ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে কারখানাভেদে শ্রমিক-মালিক আলোচনা করে ছুটির সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
শ্রমিক নেতাদের এপ্রিলের ১০-২০ দিনের বেতনের দাবি প্রসঙ্গে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এ বিষয়ে টিসিসি সভায় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। যদি কোনো মালিকের সামর্থ্য থাকে এবং তারা ইচ্ছুক হন তবে দিতে পারেন।’
কৃতজ্ঞতাঃ বনিকবার্তা
মতামত লিখুন :