টিপু সুলতান: গোটা বিশ্ব আজ থমকে দাড়িয়ে আছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কোন দিকে নিয়ে যাবে কেউ জানে না। আমরা স্বপ্ন বিচারী মানুষ স্বপ্ন দেখি কিন্তু আমাদের স্বপ্ন বা পরিকল্পনা কখন কোন দিকে মোড় নিবে তা কেউ জানে না। এটাই মানবজাতির ধর্ম। প্রতিটি দেশ তার তার নিজ কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন । থেমে নেই আমাদের দৈনিন্দন জীবন ধারা। যুদ্ধ কোন ভাবেই কাম্য নয়। সাম্প্রতিক সময়ের এই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এক ধরনের অস্থিরতা গোটা মানবজাতিকে ভাবিয়ে তুলেছে। কোন দিকে যাচ্ছে বিশ্ব রাজনীতি আর অর্থনীতি ?
বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। সবুজ শ্যামলীমায় ১৮ কোটি মানুষ সুখে দুঃখে যেমনি থাকুক ভালো আছে। কিন্তু এই যুদ্ধ আমাদের কিভাবে প্রভাবিত করবে, তা ভাবনার বিষয় কারন প্রকৃত অর্থে আমরা রপ্তানীযোগ্য পন্যের উপর এ দেশের অর্থনীতি নির্ভর করে। ফলে গার্মেন্টস শিল্প যে ঝুকিঁর মধ্যে আছে তা ভাবা যায়।
একটি গুরুত্বপূর্ন আলোচনার বিষয় নিয়ে দু’ কথা লিখতে চেষ্টা করছি তা কতটা পাঠকদের উপকারে আসবে জানি না। তার আগে একটু আলোচনা করতে চাই, বাংলাদেশ মূলত গার্মেন্টস শিল্পের উপর ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে। আশির দশক হতে এই শিল্পের যে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে বর্তমানে তা মারাত্বক অবনতি আমরা দেখতে পাইতেছি। সরকার তাদের এক ধরনের বক্তব্য, যা শিল্পের উন্নয়নের সামগ্রিক উন্নতি বিবেচনা করে বলেন কিন্তু আমরা যারা এই শিল্পের সাথে জড়িত তাদের বক্তব্য কিন্তু স্পেসিফিক। এই শিল্পের সাথে যেহেতু জড়িয়ে আছি তাই মাঝে মাঝে চেষ্টা করি দু’ কথা লেখার। কোন কোন শিল্প এগিয়ে যাচ্ছে আর কোন কোন শিল্প পিছিয়ে পড়ছে অথবা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার কয়েকটি কারন যদি বলি যেমন-
১. গ্রুপ জাতীয় কোম্পানী গুলো বিকাশ করছে
২. ছোট, যারা সাব-কন্ট্রাক্ট কাজ করে ফ্যাক্টরী গড়ে তুলেছিল তারা হোঁচট খাচ্ছে
৩. শ্রমিকের বেতন বেড়েছে সেই সাথে অন্যান্য সকল খরচ বেড়েছে কিন্তু উৎপাদন আর পন্যের দাম বাড়েনি।
৪. শ্রমিকের বেতন বাড়লেও শ্রমিকের উন্নতি হয়নি।
৫. বেতন বাড়লে ঘর ভাড়া আর দ্রব্যের যে পরিমান উর্দ্ধগতি হয় তাতে শ্রমিকের ভাগ্যের চাকা ঘুড়েনি।
৬. ছোট ছোট কটেজ ফ্যাক্টরী যে গুলো এক সময় বড় ফ্যাক্টরীর হবার স্বপ্ন গড়ে তা বন্ধ হয়ে যাইতেছে
৭. প্রতিযোগতার বাজারে টিকে থাকতে শিল্পের সেক্টরে পরিবর্তন আাসছে
৮. ইলেকট্রনিক্স পন্যের বাজার বাড়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
৯. ঔষধ শিল্পের বিকাশ এবং নতুন নতুন বাজার তৈরী হচ্ছে।
১০. প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় শ্রমিক কখনো বেকার হচ্ছে বা তাদের কাজের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে।
১১. গ্রামাঞ্চলে বা নিজ নিজ এলাকায় কৃষিজাত বা গবাদি শিল্পের বিকাশের ফলে গার্মেন্টস শ্রমিক সংকট তৈরী হচ্ছে। কারন শ্রমিক গ্রামে সেটল হচ্ছে।
যাই হোক কয়েকটি কারন যা বর্তমানে আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। অনেকটা সময় পাড়ি দিয়েও আমরা আজও এ শিল্পের ভবিষ্যত কে ঝুকিঁমুক্ত করতে পারিনি। গড়ে উঠেনি কোন ভাল এবং টেকসই শিল্পনগর। যেখানে শ্রমিক কর্মচারী এক এলাকায় বেড়ে উঠবে। যেখানে সম্পূর্ন একটিা জীবন কাঠামো বজায় থাকবে। শিল্পের টেকশই ভবিষ্যত নিশ্চিত হবে যেমন-
১. একটি পন্যের সকল যোগান নিশ্চিত করা যাবে
২. সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহার করা হবে
৩. পন্যের সঠিক গুনগত মান আর পন্য রপ্তানী সঠিক সময় বজায় থাকবে।
৪. ফ্যাক্টরী কন্ট্রোল পলিসি নিবির ভাবে করা যাবে
৫. যত্রতত্র ফ্যাক্টরী গড়ে উঠা বন্ধ হবে।
৬. নদীপথে শিল্পের রপ্তানী ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে আজ যেভাবে সড়ক ব্যবস্থাপনার বিকাশ হচ্ছে সেই ভাবে যদি নদী পথের বিকাশ ঘটতো তাহলে এই দেশে শিল্প বিকাশের পথ আরও প্রসারিত হতো। গত ৪/৩/২০২২ ইং তারিখে ফরিদপুর জেলায় যাতায়াতের পথে দেখলাম পাটুরিয়া ফেরিঘাটের পাশে বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে সোলার প্যানেল বোর্ড বসানো হয়েছে যেখানে বিদ্যুত উৎপন্ন হচ্ছে। মনে হলো। এই খানে যদি গার্মেন্টস শিল্পকারখানা গড়ে উঠতো তাহলে এই এলাকায় নগরায়ন হতো। নদীপথে শিল্পপন্য রপ্তানীর সুযোগ সৃষ্টি করা যেতো। কেন হয়নি ? হয়তো রাজনীতির বা বৈশ্বিক রাজনীতির আলোর পথে বাধাঁ হয়ে আছে এ দেশের শিল্প রাজনীতি। আলোচনার অনেকাংশ জুড়ে ‘হয়তো’ শব্দের প্রয়োগ করেছি যা এখনো সম্ভব। শিল্পের বিকাশে যেভাবে বন উজার করে,ফসলী জমির খেত খামার ধ্বংশ করা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত খাদ্য আমদানী করে খাবার খেতে হবে। কাপড় খেয়ে তখন যে কোন দূর্যোগ দূর্বিপাকে পেট ভরবে না। খাবার লাগবে। জমি থাকলে তা চাষ করে দু’মুঠো পেটের ভাততো জুটবে।
আসল কথা বলতে চাই- ফ্যাক্টরীর যারা ফ্যাক্টরীর মালিক হয়েছেন তাদের মধ্যে কেউ কঠোর পরিশ্রম করে মালিক হয়েছেন আবার কেউ মালিক হয়েছেন উত্তরাধিকার সুত্রে। যারা কঠোর পরিশ্রম করেছেন, ফ্যাক্টরীর সাথে যারা নিবির ভাবে জড়িত ছিলেন তারা জানেন কিভাবে ফ্যাক্টরীর চলে, কি কি প্রাকটিশ হয় সেখানে। কিভাবে ছুটি নিতে হয়, কিভাবে বেতন বোনাস দিতে আর নিতে হয়, ছুটির টাকা কি এবং তা কত গুরুত্বপূর্ন তা একজন শ্রমিক কর্মচারীর জীবনে, বোনাসের টাকা দিয়ে শ্রমিক কর্মচারী তার প্রেমিকা বা বউকে কিভাবে সাজাতে আর রাঙ্গাতে চায়। অনেক বিষয় আছে জানার আর বুঝার। কতটা জানি আর মানি আমরা ? বা কতটা মানতে রাজি আছি বা কমপ্লায়েন্ট আমরা। মালিক হিসেবে তার অধীনস্ত প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তাকে যদি বলি বেটা ম্যানেজ করে চল আর তার জন্যই তোমাকে বেতন দেয়া হচ্ছে। তাহলে এই জাতির ভাগ্যে কি ঘটবে তা আপনারা ভাল করে জানেন। আমার এক কমপ্লায়েন্স অডিটর বন্ধু বলল, এই আমরা যারা কমপ্লায়েন্সে অডিটর হিসাবে কাজ করি তারা যদি না থাকতো, মনে হয় রানা প্লাজার মতো আর তাজরীন ফ্যাক্টরীর মতো ব্যবস্থাপনা কাঠামোই আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে চলতো। অবাক হয়ে ভাবতে হয়, জ্ঞান গম্ভীর সৎ লোকের পক্ষে অনেক সময় চাকরী করা কঠিন হয়ে পড়ে। সবাই তোষামোদী করে চলতে পারে না। ছেড়ে যেতেও চায় না হেরে যাবার কলঙ্ক গায়ে মেখে। কি হবে তাদের ? এই যারা মানে না আর মানতে পারে না !
একটা ফ্যাক্টরী যদি সঠিক সময়ে বেতন না দেয়, ছুটির টাকা সময় মতো না দেয় বা দেয় না,বোনাস দিতে কষ্ট হয়, বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধি দিতে অনীহা এবং নিয়ম মানতে অব্যবস্থাপনার আশ্রয় নেয় তাহলে কত যে অব্যবস্থাপনার ফাক ফোকঁর গলিয়ে কত প্রকার আর্থিক ক্ষতিহয় তা আমরা অনেকেই জানি না । যেমন-
১. শ্রমিক চাকুরী ছেড়ে চলে যাবে
২. শ্রমিক সংকট দেখা দিবে
৩. জনবল নিয়োগে সবার দারস্থ হতে হবে
৪. শ্রমিক সুযোগ বুঝে নানা অজুহাতে ছুটি নিবে
৫. শ্রমিকের নিকট দায়বদ্ধতা বাড়তে থকেবে
৬. কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করবে
৭. উৎপাদন কমে যাবে
৮. শ্রমিক কখনো নানা অজুহাতে ফ্যাক্টরীতে অনুপস্থিত হয়ে ছুটি নেবার চেষ্টা করবে বা নিবে।
৯. শ্রম অসন্তোষ দেখা দিবে
১০. শৃংঙ্খলা ভেঙ্গে পড়বে।
বায়ার এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার কাছে অত্র ফ্যাক্টরী তার গ্রহনযোগ্যতা হারাবে। এ ভাবে দেশের অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব পড়বে। দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। জনবলের কাজ করার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। এভাবেই এই রকম নানা অব্যবস্থাপনা আমাদের দেশের ফ্যাক্টরীর উপর চেপে বসে আছে। তা আমরা কয়জন জানি ! টেকশই চাকুরী ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে,জবাবদিহীতা নিশ্চিত করতে হবে, দক্ষ জনশক্তি আর মেধাবী মানুষদের এই সেক্টরের প্রতি আস্থাবাঞ্চক কাঠামো গড়তে হবে। আইন আমাদের জানতে, বুঝতে আর মানতে হবে। নইলে প্রকৃতিগত ভাবেই একটি ব্যবস্থাপনা কাঠামো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যা আমরা কেউ খতিয়ে দেখছি না। এ দেশের কোন কোন প্রতিষ্ঠান টিনের চশমা পড়ে আছে আজও!
লেখক: টিপু সুলতান
জেনারেল ম্যানেজার, আলিফ ক্যাজুয়াল ওয়্যার লিমিটেড।
মতামত লিখুন :