আখলাকুর রহমান : ১৬ কোটির ওপরে যে দেশের জনসংখ্যা সেই দেশের অভ্যন্তরীন বানিজ্য মুল্য যে হাজার হাজার কোটি টাকার সে কথা আমারা বেমালুম ভূলে গিয়েছি। রপ্তানি বানিজ্য বৃদ্ধির জন্য আমরা মরিয়া হয়ে যাচ্ছি, বৃদ্ধিও হচ্ছে। রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য বিদেশী বিনিয়োগকারীদের স্বল্প ভাড়ায় দীর্ঘ মেয়াদে মূল্যবান ভূমি সহ গ্যাস, বিদ্যুত, বন্দর, রাস্তা-ঘাট সহ অন্যান্য সুবিধা ব্যবহার করার সুযোগ দিচ্ছি। হ্যাঁ, বিশ্ব বানিজ্যের এই যুগে বহির্বিশ্বে বানিজ্য সম্প্রসারণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তা-ই করতে হবে, আপত্তি নেই। কিন্তু রপ্তানি বানিজ্য বাড়াতে গিয়ে নিজেদের বানিজ্যের মাঠ যে, বিদেশীদের বানিজ্যের হাট হয়ে গিয়েছে সেই বিষয়ে মনে হচ্ছে কারো অন্তর দৃষ্টি নেই। রপ্তানি বানিজ্যের মাধ্যমে যে পরিমাণ ডলার আয় করে হচ্ছে এর বেশির ভাগ ডলারই আবার আমদানি বানিজ্যের দেনা মেটাতে শেষ হয়ে যায়। একটি দেশকে স্ব-নির্ভর ও শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে অভ্যন্তরীন পণ্য-দ্রব্যের চাহিদা বা উৎপাদন দেশে-ই করার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশীয় কাঁচামালা, শ্রম আর বাজারের সর্বোচ্চ উপযোগ নিশ্চিত করতে না পারলে বহুজাতিক কোম্পানী ও ভু-রাজনৈতিক আগ্রাসনের ছোঁবল থেকে রক্ষা করা কঠিন হবে বাজার অর্থনীতি।
বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরী পোশাক রপ্তানি কারক দেশ। বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু আমরা নিজেদের কাপড় বা পোষাকের চাহিদা পুরণ করছি আমদানি করে। বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্থান, চীন, থাইল্যান্ড থেকে সকল প্রকার পোশাক আমাদানি করে থাকে। মহিলা ও মেয়েদের সালোয়ার- কামিজ ও শাড়ির বেশীর ভাগ ভারত থেকে আমদানি করা হয়। এই আমাদানি করা কাপড়ের পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা। গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ শ্রেণীর মানুষদের কাপড়ের একটি চাহিদা পুরণ করে থাকে নরসিংদী, নারায়ানগঞ্জ এবং টাঙ্গাইল থেকে তৈরী সুতা ও কাপড় থেকে।
বাংলাদেশের মানুষের ব্যবহৃত প্রসাধন সামগ্রির শত ভাগই আমদানি নির্ভর এবংএই আমদানির পরিমাণটাও একেবারে কম নয়। বাচ্চাদের স্কূল ব্যাগ সহ সকল প্রকার ব্যাগ, ট্রলি, স্যুটকেস আমদানিকৃত এবং এর বাজার মূল্য শত হাজার কোটি টাকা।
এছাড়াও চীন থেকে চশমা, কলম, ইলেট্রনিকস সামগ্রী, খেলনা সহ এহেন কোন দ্রব্য নেই যা আমদানি করা হয় না।
আবার কৃষি পণ্যের একটা বিরাট অংশও আমদানি করতে হয় বিশেষত ভারত থেকে। এই পর্যন্ত ভারত ও নেপাল থেকে যে পরিমাণ গরু আমদানি করা হয়েছে, যদি এর সিকি ভাগ গরুও দেশীয় খামারে বা কৃষক ব্যক্তি পর্যায়ে উৎপাদন করতে পারতো তবে সেই টাকা দিয়ে কতগুলো পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা সেতু নির্মাণ করা যেত তা নিশ্চয় সকলেরই অনুমেয়। বাংলাদেশে পেয়াজ রপ্তানিকারকরা ইদানিং পেয়াজের যে দাম বৃদ্ধি করেছেন, সেই দাম অসহনীয় পর্যায়ে এসে পড়েছে।
প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ তৈরী পোশাক, জুতো, ঔষুধ, হিমায়িত খাদ্য, সবজি, সিরামিক, চামড়া, সাইকেল সহ নানা প্রকার পণ্য বিশ্বে রপ্তানির ক্ষেত্রে যদি চীন, ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্থান, হংকং, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম সহ কতিপয় দেশের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজের বাজার দখল ও সম্প্রসারণ করতে পারে তবে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বাজার বিদেশীদের দখল মুক্ত করতে পারবেনা কেন?
দেশীয় বানিজ্যের এই হাজার হাজার কোটি টাকার বাজার, বিদেশীদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে না পারলে প্রকৃত অর্থনৈতিক মেরুদন্ড শক্ত ও ঠেকসই হবে না। আমদানি নির্ভর এই সকল খাতকে স্ব-দেশী করতে হলে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে কাজ করতে হবে একসাথে। দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ করতে হবে ঐসকল আমদানি নির্ভর খাতে। বিনিয়োগের জন্য উদ্যোক্তাদের প্রণোদনাসহ যাবতীয় সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকেই। আবার শিক্ষিত বেকার ও তরুণ উদ্যোক্তাদের দেশে-বিদেশে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান ও স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করে মহান এই বিপ্লবের ভার দিতে হবে সৃষ্টিশীল তরুণদের হাতেই। সম্ভাবনাময় লক্ষ লক্ষ কর্মক্ষম তরুণদের কাজে লাগাতে না পারলে, বিদেশী ও বহুজাতিক কোম্পনিরগুলোর আগ্রাসনের স্রোতে হয়তো হারিয়ে যাবে আমাদের সব অর্জন। আবার ঢাকা সহ বড় বড় শহরের সুপারমলগুলো বিদেশী পণ্যে সাজানো কিন্তু একটু উদ্যোগ নিলেই এই সকল বিল্ডিংগুলো পণ্য উৎপাদনের কারখানায় পরিণত করা যায়। শহর, উপশহর ও গ্রাম-গঞ্জের উদ্যোমী তরুণদের ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তা হিসাবে তৈরী করতেই হবে, আমাদের দেশীয় বাজার রক্ষার জন্য।
দেশীয় ও আন্ত-মহাদেশীয় বানিজ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের রকেট বিজ্ঞান (Rocket Science), পরমাণু বিজ্ঞান ও ইউরেনিয়াম চুল্লিতে (Atomic science and Uranium power plant)পারদর্শী হওয়ার প্রয়োজন নেই। এদেশের স্বপ্নচারী তরুণ শিক্ষিত জনবল, কাঁচামাল উৎপাদনের সম্ভাব্যতা, কৃষির জন্য উর্বর জমি এবং দীর্ঘসময় কাজ করার মানসিকতা-ই যথেষ্ট। উদাহরণ স্বরুপ ঔষুধ শিল্পের কথা বলছি। এটা এখন দেশে পেরিয়ে বিশ্ব জয়ের পথে। প্রাণ গ্রুপ ৩৫টির বেশী দেশে ভোগ্য পণ্য রপ্তানি করছে, সাথে দেশের বাজারও তাদের দখলে। রংপুরের শতরঞ্জির কথা শুনে থাকবেন, দেশের বাজার ছাড়িয়ে এখন বিশ্ব বাজারে। রাজশাহীর কিছু বাগান থেকে আম এখন ওয়াল মার্টের দোকানে (WalMart is the biggest American chain store and also presence in UK by the name of ASDA store). এই রকম অনেক উদাহরণ আছে। এখন শুধু প্রয়োজন নীতি নির্ধারক মহলে সততা, নিষ্ঠা, ইচ্ছা, বাজার ব্যবস্থাপনা, তরুণ উদ্যোক্তার কাজে লাগোনো এবং সকল মহলে সচেতনতা বৃদ্ধি।
হ্যাঁ, স্ব-নির্ভরতার যুদ্ধটা শুরু করতে হবে সময় থাকতেই। দেশের জনসংখ্যা হুহু করে বেড়েই চলছে সাথে বাঁড়ছে মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা। আমদানিকৃত এই সকল পণ্যের জন্য ব্যয় হচ্ছে রপ্তানি আয় ও বিদেশিদের পাঠানো কষ্টার্জিত রেমিটেন্স বা রির্জাভ মানির কোটি কোটি ডলার। এই যুদ্ধ ও যুদ্ধ জয়ের কৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে জাতি হিসাবে নিজ মেরুদন্ডের ওপর শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য। ভু-রাজনীতিতে জয়ী হওয়ার জন্য।
লেখক: পরিবেশবিদ ও কমপ্লায়েন্স পেশাজীবি
মতামত লিখুন :