তৌহিদুল ইসলাম চঞ্চল : ঈদ মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। এই ঈদ কে ঘিরে অনেক পরিকল্পনা, আশা আকাঙ্খা, আনন্দ জড়িয়ে থাকে। বর্তমানে মানুষের যান্ত্রিক জীবনের ছন্দপতনে এবং কদিন মানুষ হিসেবে জীবন যাপনের উপলক্ষ্য এই ঈদ। শত ব্যস্ততা-ক্লান্তির মাঝে যেন এক স্বর্গীয় প্রশান্তি বয়ে আনে এই ঈদ। পৃথিবীর সকল মুসলিম এই ঈদ কে ঘিরে যে আনন্দময় সময় কাটায় বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীও তার বাইরে নয়। এখন আমরা যদি বলি গরীব দুঃখীদের কিংবা মধ্যবিত্তের আবার ঈদ! আমাদের মাঝে এই অনুভূতিটা আসা স্বাভাবিক কারণ ভ্রাতৃত্ব সৌহার্দ্য এর যে বাঁধন কিংবা সমাজের সকল শ্রেণীর যে মেলবন্ধন গত ১ যুগ আগেও পরিলক্ষিত হয়েছিল তা আজ অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। মানুষে মানুষে সম্পর্কে যে ব্যবধান আজ তা ঈদের আনন্দকে অনেকটাই কমিয়ে দেয়। মানুষ তার আপন গণ্ডি করে নিয়েছে তার সকল কর্মকাণ্ড সকল চাওয়া পাওয়া ঐ একই গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ। হবে না কেন নিজের চাহিদা মিটাতেই যে সকলের নাভিশ্বাস উঠে যায়। হয়ত তার চেয়ে নিম্ন আয়কারীদের তার কাছ থেকে কিছু পাবার কথা ছিল, হয়ত তার আশেপাশের অনেকে ঈদের দিন তার বাড়ীতেই খাওয়া দাওয়া করবে এ আশায় বুক বেঁধে ছিল। কিন্তু যার পথ পানে তারা চেয়ে রয় সেও যে আজ সমাজ সংসারে হিমসিম খাওয়া একজন সৈনিক। তবুও আমাদের যা আছে তাই নিয়ে ঈদকে ঈদের আনন্দকে আমরা সফল করার প্রানান্ত প্রয়াস করে যাই।
বাংলাদশের পোশাক শিল্পের মালিক, শ্রমিক, কর্মকর্তাদের (একদিক থেকে তাঁরাও শ্রমিক) ঈদের হালচাল যদি জানতে চাই তবে গত কয়েকযুগের পেপার পত্রিকা দেখলে একটু আঁচ করতে পারবো আমরা। আমাদের সংবাদমাধ্যম গুলোর ঠিক ঈদের আগে যেই খবরগুলি শিরোনাম হয় তার মধ্যে, জ্যাম, সড়ক দুর্ঘটনা, ঈদে বাড়ী ফেরা মানুষের ভিড় আর বিভিন্ন পোশাক কারখানায় ঈদ বোনাস ও বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষ! সমাজের অন্যান্য পেশাজীবী জনগোষ্ঠী বাকি তিনটি খবরের সাথে জড়িত থাকে আর একমাত্র পোশাক শিল্পের কর্মরত মানুষেরা সবগুলি খবরেরই অংশ। যদি মূল বিষয়টির অনুসন্ধান করি তবে জানতে পারবো যে অধিকাংশ কারখানাই তাদের শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস পরিশোধ করে আর স্বল্প কিছু সংখ্যক তা করেনা। আমাদের এর আগে একটু দাবী আর অধিকার পার্থক্যটা জানা উচিৎ। দাবী হল যা কোন আইনে উল্লেখ নেই কিন্তু তা শ্রমিকদের একটি চাহিদা (উল্লেখ্য চাহিদা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়) তার সাথে সম্পর্ক যুক্ত, আর অধিকার বলতে যা আইনে উল্ল্যেখ করা আছে সে সম্পর্কিত কোন কিছু। আবার দুইটি কথা আছে সময় অসময়। স্বল্প কিছু কারখানা ব্যতিরেকে অধিকাংশ কারখানাই শ্রমিক আইনে বেঁধে দেয়া নির্দেশনা সমূহ মেনেই সমস্ত বকেয়া পরিশোধ করছে কিন্তু তা আসলে মানবিক কিনা সেটাও একটু চিন্তা করা দরকার। যেখানে শ্রমিকদের বাড়ী যাবার জন্য একমাস আগে বাসের টিকেট বুক করতে হয়, ঠিক তেমনি তাদের ঈদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদের বোনাস টাও একটু আগেভাগে দেয়া যায় কিনা? বলবেন আগে দিলে সে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকতে পারে! আপনার কারখানায় যদি প্রতিদিন ৫% অনুপস্থিতি থাকে তবে বোনাস দেয়ার পরের দিন শতকরা পরিমান কত হবে ৭% কিংবা ৮%? কিন্তু যদি এ নিয়ে অসন্তোষ হয় , শ্রমিকরা যদি অসন্তুষ্ট হয়ে কাজ বন্ধ করে দেয় সেক্ষেত্রে ১০ লাইনের একটি ফ্যাক্টরীর একদিনের প্রায় ১০,০০০ পিস উৎপাদন হয়না এর এর ফলে কোম্পানির শিপমেন্ট ব্যাহত হয়, প্ল্যানিং এ ব্যাঘাত হয়। অতিরিক্ত কর্মঘন্টা কাজ করতে হয় যা শুধু খরচ বাঁড়ায়। আমি আগেও বলেছি এমন অবস্থা হয় মুষ্টিমেয় কিছু কারখানায়। যদি আমি ধরি আপনি বৃহস্পতিবার তাকে বোনাস টা দিলেন আর শুক্রবার যদি হয় কর্মবিরতি তবে কি এই অনুপস্থিতির সম্ভাবনা থাকে? আর শ্রমিকরা সাধারণত ঈদের মাসে বেশী উপার্জন করতে চায় তারা অননুমোদিত অনুপস্থিত থাকতে চায়না। তাই আপনি যদি আসলেই আপনার শ্রমিকদের চাহিদা বোঝেন সেক্ষেত্রে তার ঈদ বোনাসটা যে আগে দিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে কিছু সুফলও পেতে পারেন তা নিশ্চয় স্বীকার করবেন। যেমন তাদের কাজে উদ্দম বাড়বে, তাদের বোনাস সংক্রান্ত কোন দুশিন্তা থাকলো না তাই তারা তাদের ভাল কাজটি দিতে পারলো। এমনটাও তো হতে পারে, তাই নয় কি? আমাদের বদ্ধমূল ধারনাগুলো থেকে আসলে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিৎ
এবার আসি সবচেয়ে নিগৃহীত শ্রমিক অর্থাৎ কারখানার কর্মকর্তা কর্মচারী উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমে অবস্থিত বেশ কিছু কারখানা থেকে এখন খবর আসে তারা তাদের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন সময়মত দেন না। কেন? কি লাভ? এমন কি কিছু জায়গায় ২/৩ মাসের বেতন বকেয়া। কেন? তাদের কি সংসার নেই? তাদের কি ঈদ নেই? নাকি কর্মক্ষেত্র কম থাকায় তার ফায়দা নেয়া হচ্ছে? আপনার কি অর্ডার কম ? আপনি কি শিপমেন্ট করছেন না? না কি টাকা হিসাব করার সময় এদের কথা মনে থাকেনা। যে আপনাকে টাকার হিসাব টা করে দিচ্ছে তার ক্ষেত্রেও এই বিলম্ব, কেন? আপনি কি পন্য শিপমেন্ট করায় আপনার যে অর্থ তা পাননি? এক্ষেত্রে আপনি তো কোন দয়া করছেন না, তাদের শ্রমের বিনিময়ে তবেই তো তারা পয়সা পায়। হালে শোনা যায় অনেকে এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যবহার করেন, আপনার টাকা আপনি যাচ্ছেতাই করেন সমস্যা নাই কিন্তু অন্তত অধিকারের বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করুন। মুষ্টিমেয় কিছু কারখানা ও তাদের অব্যবস্থাপনার জন্য অধিকাংশ কারখানাকে কেন লজ্জার সম্মুখীন হতে হবে? এর নেই কি কোন নিরাময়। প্রতি ঈদের আগে আমাদের এই শিল্প নিয়ে যখন বকেয়া বেতন, বোনাস ইত্যাদি সম্পর্কিত খবর আসে সত্যি খুব কষ্ট হয়। আমাদের মনে রাখা উচিৎ ঈদ বোনাস হল অধিকার, আর অধিকার নিয়ে কোন গড়িমসি ঠিক নয়।
লেখক : মানবসম্পদ প্রশিক্ষক
মতামত লিখুন :