Logo

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্লিজ, প্রলয়ের আগেই হস্তক্ষেপ করুন!

RMG Times
সোমবার, জুলাই ২৪, ২০১৭
  • শেয়ার করুন

গোলাম মাওলা রনি: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রপ্তানি নিয়ে আপনার কাছে গোয়েন্দারা কি রিপোর্ট দিয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে এ ব্যাপারে আপনার কাছে আমি যা বলব তা ৪০ লাখ শ্রমিক এবং পাঁচ হাজার কারখানা মালিকের ঘাম, শ্রম এবং রক্ত মাখানো আকুতি বৈ অন্য কিছু নয়। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, গত কয়েক মাসে শত শত গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সাত লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। ব্যাংকিং খাতে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নতুন করে যোগ হয়েছে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পদহানি হয়েছে আরও ২০ হাজার কোটি টাকা। গার্মেন্ট খাতের এই প্রলয় যদি এই মুহূর্তে থামানো না যায় তবে আগামী এক বছরে  ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে পড়বে এবং ১০-১৫ বছর পর বাংলাদেশের গার্মেন্ট রপ্তানি অতীতকালের ইতিহাস বলে গণ্য হবে।

গার্মেন্ট সেক্টরের এই প্রলয়ের মূল কারণ অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স নামের পশ্চিমা ক্রেতাদের দুটি বাণিজ্যিক সংগঠনের বাড়াবাড়ি, দুর্নীতি এবং বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পকে সমূলে ধ্বংস করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। রানা প্লাজা ধ্বংসের পর দেশীয় গার্মেন্টের কর্মপরিবেশ উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নাম করে তারা যে বেনিয়া মনোভাব নিয়ে এদেশে অনুপ্রবেশ করে তার কুফল সম্পর্কে আমরা কেউই আন্দাজ করতে পারিনি। সরকার, বিজিএমইএ, অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠন এবং ব্যক্তি পর্যায়ে গার্মেন্ট মালিক ও শ্রমিকরা সম্মিলিতভাবে বিগত দিনগুলোতে উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স এবং ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ডকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে কত বড় সর্বনাশের পাল্লায় পড়েছে তার কিছু নমুনা পেশ করলেই বিষয়টি আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের মাধ্যমে অনৈতিক চাপ সৃষ্টি এবং অহেতুক ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্রেতারা গত পাঁচ বছরে  গড়ে ৩০ শতাংশ মূল্য কমিয়ে নিয়েছে যা টাকার হিসাবে বছরে আট হাজার কোটি এবং এই খাতে বিগত দিনে তারা মোট ৪০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিয়েছে। বিভিন্ন ফ্যাক্টরি আধুনিকায়ন, ফ্যাক্টরির নিরাপত্তা নিশ্চিত, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনের নামে ফ্যাক্টরি মালিকদের নানাভাবে নাজেহাল, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং অনৈতিক চাপের মধ্যে ফেলে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা খরচ করিয়ে ছেড়েছে যার শতকরা নব্বই ভাগই এদেশের প্রেক্ষাপটে অপ্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত। তারা গার্মেন্ট মালিকদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব এবং শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষের বীজ বপন করে যাচ্ছে মূলত তাদের ক্রেতাদের আর্থিকভাবে ফায়দা লোটার সুযোগ করে দেওয়ার  জন্য। সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তির বলে তারা এসব কর্মকাণ্ড করার সুযোগ পাচ্ছে। চুক্তিটি আগামী বছর শেষ হতে যাচ্ছে। সরকারের সঙ্গে পুনঃচুক্তির তোয়াক্কা না করেই  ঘোষণা দিয়েছে তারা এদেশে যতদিন ইচ্ছা ততদিন থাকবে। তাদের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘোষণায় পুরো গার্মেন্ট সেক্টরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং পুরো ব্যবসা-বাণিজ্যে অশনি সংকেত দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশের মাটি মানুষ এবং অর্থনীতি নিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন বেনিয়া চক্রান্ত যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে  তা আপনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধের চক্রান্ত মোকাবেলা করতে গিয়ে। বাংলাদেশকে নিয়ে পশ্চিমাদের লুটপাট রীতিমতো ভয়ঙ্কর উপাখ্যানে পরিণত হয় ভাস্কো দা গামা কর্তৃক ভারতে আসার সরাসরি জনপথ আবিষ্কারের পর। পশ্চিমা বেনিয়াদের একটি অংশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে ব্যবসার নামে প্রথমে লুটপাট এবং পরে সময় সুযোগ বুঝে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেয়। অন্যদিকে ইউরোপীয়দের বিভিন্ন গোষ্ঠী জলদস্যুতার মাধ্যমে শত শত বছর আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে।

পশ্চিমাদের অন্যের সম্পত্তি দখল, অন্যের রাষ্ট্র তছনছ  করার মনোবৃত্তি এবং মানুষকে দাস বানিয়ে রাখার অতীত অভ্যাসের হালনাগাদ অবস্থা বোঝার জন্য আপনি বর্তমানের মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালেই সব কিছু বুঝতে পারবেন। অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের একতরফা সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্য রীতিমতো অপমানজনক। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ তাদের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কার্যক্রম নেই। বাংলাদেশে তারা যে সর্বনাশ ঘটিয়েছে তা অন্য কোনো দেশে ঘটাতে সাহস পেত না। এমনকি অন্য দেশে ঢোকার জন্য ভিসাও পেত না। বাণিজ্যমন্ত্রীর এ ধরনের প্রতিক্রিয়া অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স আদৌ গায়ে মাখেনি বা পাত্তা দেয়নি। তারা তাদের কর্মকাণ্ড একতরফাভাবে চালানোর ঘোষণা দিয়েছে।

এদিকে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ যুগপত্ভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। তারা অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সকে এদেশ থেকে তাড়ানোর জন্য সবাত্মক চেষ্টা-তদ্বির শুরু করেছে এবং সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একমাত্র আপনিই পারেন ওদের বিরত রাখতে অথবা অবিলম্বে দেশত্যাগে বাধ্য করার জন্য। আমি হলফ করে বলতে পারি, আপনার এই কর্ম অনাদিকালের সীমা অতিক্রম করে আগামীর দুনিয়ায় যুগান্তকারী ইতিহাস হয়ে থাকবে। এতে করে বাংলাদেশের গার্মেন্ট রপ্তানি বেড়ে যাবে। কোনো বৃহৎ ক্রেতা যদি বাড়াবাড়ি করে তবে আপনি তাদের কালো তালিকাভুক্ত করে তাদের স্থানীয় অফিস বন্ধ করে দেবেন। কোনো দেশ যদি হুমকি দেয় তাতে আমাদের কিচ্ছু হবে না। বরং হিতেবিপরীত হবে। আপনি যদি গার্মেন্টগুলোর জন্য প্রযোজ্য আমদানি নীতি ঠিক রেখে উৎপাদিত পণ্য দেশের অভ্যন্তরে বিক্রির অনুমতি দেন তবে গার্মেন্টগুলোর আয় দ্বিগুণ বেড়ে যাবে এবং রপ্তানিনির্ভরতা কমে যাবে। অন্যদিকে দেশীয় ক্রেতাদের জন্য আমাদের আমদানিকারকরা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে যে কাপড় ও তৈরি পোশাক আমদানি করেন তা অনেকাংশে কমে যাবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে না, বরং রিজার্ভ আরও বাড়বে। আপনার সুদৃঢ় পদক্ষেপে দেশীয় গার্মেন্ট শিল্পে বিপ্লব ঘটে যাবে। বড় বড় পশ্চিমা ক্রেতারা তখন অবনত মস্তকে এদেশে এসে চকবাজার, ইসলামপুর, কেরানীগঞ্জ, গুলিস্তান, বঙ্গবাজার প্রভৃতি পাইকারি বাজার থেকে তৈরি পোশাক কিনে নিজেদের দেশের চাহিদা মেটাতে বাধ্য হবে। আপনার সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি, আমাদের আমদানিকারকরা কিন্তু চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের পাইকারি বাজার ঘুরে ঘুরে প্রতিমাসে শত শত কন্টেইনার তৈরি পোশাক আমদানি করে থাকে। আমরা একটু সাহসী হলে দৃশ্যপটটি সম্পূর্ণ উল্টে গিয়ে বিদেশি ক্রেতাদের আমাদের পাইকারি বাজারগুলোতে আসতে বাধ্য করা যাবে।

লেখক: সাবেক সাংসদ, কলামিস্ট। 

সৌজন্যে : বাংলাদেশ প্রতিদিন