Logo

একজন এজিএম’র নিয়োগপত্র, টার্মিনেশন ও প্রসঙ্গকথা

RMG Times
শনিবার, জুন ১৭, ২০১৭
  • শেয়ার করুন

ড. উত্তম কুমার দাস: ভদ্রলোক আমার বন্ধুস্থানীয়। প্রথম পরিচয় লিঙ্কডইন’র মাধ্যমে। তারপর ক্রমাগত যোগাযোগ, পেশাগত কার্যক্রমে দেখা-সাক্ষাৎ। তিনি একটি ‘স্বনামখ্যাত” প্রতিষ্ঠানের এজিএম। তাঁর চাকরি নিয়ে টানাটানি চলছে। এই বিষয়ে আমার পেশাগত কার্যক্রম বলেই তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
 
ভদ্রলোকের সমস্যা- তার নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান তাকে মার্চ মাসে ইস্যু করা এক পত্রে “টার্মিনেট” করেছে। উক্ত পত্রে যা বলা হয়েছে তার অনুবাদঃ
“… আমাদের আগে ইস্যু করা চিঠির প্রেক্ষিতে জানাচ্ছি, অডিটের দিনে সময়মত অফিসে উপস্থিত থাকার প্রয়োজনীয়তা আপনি ক্রমাগত লঙ্ঘন করেছেন বলে দেখা গেছে। একই বিষয় ক্রমাগত করা আপনার কাজ এবং দায়িত্বের প্রতি মারাত্বক অবহেলার বহিঃপ্রকাশ।
বিধায়, আপনার কাজকর্ম মেনে নেয়া ব্যবস্থাপনা-পক্ষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই, আপনার চাকরির অবসান করা হল (Terminated) যা অবিলম্বে কার্যকর হবে…”।
 
তাঁর নিয়োগপত্রে চাকরি অবসানের যে শর্ত তার বাংলা অনুবাদঃ
(খ) আপনার চাকরি স্থায়ী হলে, আপনি আপনার চাকরির অবসান চাইলে এক মাসের নোটিশ অথবা তার বদলে প্রতিষ্ঠানকে সম-পরিমাণ অর্থ দিয়ে তা করতে পারবেন। একইভাবে, ব্যবস্থাপনা-পক্ষ এক মাসের নোটিশ কিংবা তার বদলে ওই সময়ের জন্য প্রাপ্য অর্থ দিয়ে তা করতে পারবেন।
 
(গ) চাকরি চলাকালে যদি ব্যবস্থাপনা-পক্ষের কাছে মনে হয় যে প্রতিষ্ঠানের জন্য আপনার কাজকর্ম সন্তোষজনক নয়, তাহলে কোন নোটিশ বা আর্থিক ক্ষতিপূরণ ছাড়াই আপনাকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া যাবে (.. service may be terminated or discontinued) [যেমনটি এই চিঠির/চুক্তির আগের পয়েন্টে উল্লেখিত]।“
বিষয়টি দেখে কিছুটা হতবাকই বটে।
 
কোন একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে জনবল নিয়োগ একটি চলমান প্রক্রিয়া। একই সঙ্গে তাদের চাকরির অবসানত্ত হতে পারে। তবে তা হতে হবে প্রচলিত আইন, বিধি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চাকরি বিধি প্রভৃতির আলোকে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব চাকরি বিধি (House policy) সম্পর্কে বলা যায় উক্ত চাকরি বিধির কোনও শর্ত প্রচলিত আইনে প্রযোজ্য বিধানের চেয়ে কম হওয়া যাবেনা (বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬, ধারা ৩)। এতে কোন ফাঁক থাকলে মানতে হবে এই ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রথা, যাতে থাকবে ন্যায় বিচারের ছায়া ও নীতি।
 
শ্রম আইন বেসরকারী বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠান, শিল্প প্রতিষ্ঠান, কারখানা (যেমন- গার্মেন্টস), ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, সংবাদপত্র প্রভৃতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এসকল প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক (ও কর্মীরা) অনেক ক্ষেত্রে বে-আইনী ভাবে চাকরী হারান। উপরের ঘটনা তার একটি উদাহরণ মাত্র। আইন দৃষ্টে তাঁর চাকরী বহাল রয়েছে। দোষারোপ করায় টার্মিনেট হয়নি।
 
কোন মালিক বা নিয়োগকারী কোন কারণ ছাড়াই তার কোন শ্রমিক (বা কর্মীকে) টার্মিনেট করতে পারেন। এক্ষেত্রে স্থায়ী শ্রমিক বা কর্মীর ক্ষেত্রে ১২০ দিনের লিখিত নোটিশ দিতে হবে। অন্যথায় (নোটিশের বদলে) ১২০ দিনের মজুরী (মূল মজুরী) দিতে হবে (শ্রম আইন, ধারা ২৬)।
 
তবে বড় কথা হল- টার্মিনেট করা অপরাধ জনিত কোনও শাস্তি নয়। বরং নিয়োগকারিরই সুবিধায় কারও চাকরির অবসান। কাউকে দোষারোপ করে (Stigma) টার্মিনেট করা যাবেনা। [অপরাধ করলে তাঁর জনে অন্য প্রক্রিয়া (শ্রম আইন, ধারা ২৩ ও ২৪)]।
 
কোন কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, বিশেষতঃ তাদের কর্মকর্তাদের (যারা শ্রমিকের প্রথাগত সংজ্ঞার বাইরে) চাকরির নিয়োগপত্র বা চুক্তিপত্রের দোহাই দিয়ে (যা সংশ্লিষ্টরা “মেনে নিয়ে” যোগদান করেছেন বলে দাবি করা হয়) টার্মিনেশনের ক্ষেত্রেও কোন ক্ষতিপূরণ দিতে চায়না। ন্যায় বিচারের নিরিখে তা আইন-সঙ্গত নয়।
 
আলোচ্য কথিত কর্মকর্তার যে চাকরি- এজিএম (…) তা মুলতঃ কারিগরি কাজ (টেকনিক্যাল), তা প্রধানতঃ প্রশাসনিক নয়। তাই শ্রম আইনের নিরিখে তিনি মুলতঃ একজন শ্রমিক [ধারা ২(৬৫)]। তাই তার টার্মিনেশনের ক্ষেত্রে শ্রম আইনের বিধান প্রযোজ্য হবে।
অনেকের ধারণা বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ শ্রমিকদের জন্য করা একটি আইন। এই ধারণা ভুল। এই আইন মুলতঃ কর্মসংস্থান ও শ্রম সংক্রান্ত বিধান। এতে কর্মে নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলী, প্রসুতি কল্যাণ সুবিধা, স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থা, নিরাপত্তা, কল্যাণমূলক ব্যবস্থা, কর্মঘণ্টা ও ছুটি, মুজুরি নির্ধারণ ও তা পরিশোধ, দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ, শিল্প সম্পর্ক, মুনাফায় অংশগ্রহণ, ভবিষ্যৎ তহবিল, শ্রম আইন লঙ্ঘনের দণ্ড প্রভৃতি বিষয়ে বিধান রয়েছে। এছাড়া মুজুরী বোর্ড, শ্রম আদালত, শ্রম আপিলেট ট্রাইব্যুনাল, শ্রম প্রশাসন ও শ্রম পরিদর্শন কি ভাবে প্রচালিত হবে তার বিধানও দিয়েছে শ্রম আইন।
তবে শ্রম আইন কিছু ক্ষেত্রে (যেমন- কর্মে নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলী, কল্যাণ সুবিধা, স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থা, নিরাপত্তা, কল্যাণমূলক ব্যবস্থা, কর্মঘণ্টা ও ছুটি, মুজুরি নির্ধারণ ও তা পরিশোধ প্রভৃতি বিষয়ে) শ্রমিকদের বিষয়ে যত স্পষ্টভাবে বিধান দিয়েছে, যারা শ্রমিক সংজ্ঞার বাইরে পড়বে অথচ একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সে বিষয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। পরবর্তী আইন সংশোধনকালে তা সংশোধন করা দরকার। অথবা তাদের জন্যে আলাদা আইন করতে হবে।
যতদিন তা না হচ্ছে ততদিন কি জীবন থেমে থাকবে? কারও কারও অধিকার-বঞ্চনা চলবে?
 
আমার যুক্তি হল যে প্রতিষ্ঠান শ্রম আইনের বিধানে চালু হয়, সব কিছু এই আইনের বিধানে চলে, শ্রমিকদের ক্ষেত্রে শ্রম আইনের শর্ত মানা হয় (যারা মানছেন) সেই প্রতিষ্ঠানেরই যারা শ্রমিক সংজ্ঞার বাইরে তাদের কর্মে নিয়োগ ও চাকরীর শর্তাবলী, কল্যাণ সুবিধা, স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থা, নিরাপত্তা, কল্যাণমূলক ব্যবস্থা, কর্মঘণ্টা ও ছুটি, মুজুরি নির্ধারণ ও তা পরিশোধ প্রভৃতি বিষয়ে) আইনের একই বিধান মানা যুক্তিযুক্ত।
 
আমাদের এখানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের আইনজীবী ও মানব সম্পদ বিষয়ক ব্যবহারজীবীদের কারও কারও মধ্যে ধারণা যারা “কর্মকর্তা” তারা সংশ্লিষ্ট চাকরীর চুক্তির শর্ত মেনেই নিজেদের “অধিকার বিসর্জন” দিয়ে চাকরীতে যোগদান করছেন! তাঁরা চুক্তি আইনের দোহাই দেন।
 
তবে চুক্তি আইন একটি ব্যাপক আইন। এটা সত্য যে, প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী দু’জন (বা তার অধিক) ব্যক্তি চুক্তি সম্পাদন করতে পারেন। তবে এই ক্ষেত্রেও বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা এবং মানদণ্ড রয়েছে। বিভিন্ন দেশের উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তেও কিছু মানদণ্ড তৈরি হয়েছে।
 
কোনও প্রতিষ্ঠানের চাকরি বিধি বা নিয়োগপত্রে- “… আপনার চাকরি বিনা নোটিশে টার্মিনেট বা ছেদ ঘটানো যাবে এবং এজন্যে আপনাকে কোন নোটিশ এবং/অথবা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবেনা…”- এহেন কথা যদি উল্লেখ থাকে তা আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ (Void). এমন চুক্তি আইনের ভাষায় যথাযথ নয় এবং বিবেকতা-বর্জিত (Unfair and unconscionable agreement)। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট গণ-নীতিমালার (Public policy) বিরুদ্ধে হওয়ায় এমন চুক্তিকে বাতিল বলে ঘোষণা করেছেন।
 
ব্রিটিশ চুক্তি আইনের নীতি হল- কোন চুক্তির শর্ত সাংবিধানিক বিধান, গণ নৈতিকতা, একই বিষয়ে বিধিবদ্ধ আইন থাকলে তার বিধান – এসবের পরপন্থী হতে পারবে না।
একই প্রতিষ্ঠানের শ্রমিককে বিদায় (টার্মিনেশন) করতে যদি ১২০ দিনের নোটিশ বা তার বদলে মুজুরি দিতে হয় তাহলে কথিত কর্মকর্তার ক্ষেত্রেও কেন একই ক্ষতিপূরণ প্রযোজ্য হবে না?
এই বিষয়ে সমাধান কি? আমার মতে এর জন্য স্বল্প-মেয়াদী ও দীর্ঘ-মেয়াদী সমাধান খুঁজতে হবে।
১। প্রথম উদ্যোগ হতে হবে ব্যক্তি পর্যায়ে- যিনি চাকরীতে যোগদান করছেন প্রথমেই দেখা আপনার জন্য প্রযোজ্য শর্তসমুহ কি। চাকরীদাতারও খেয়াল রাখা দরকার আপনি বে-আইনী কিংবা প্রথা বিরোধী কোন শর্ত দিচ্ছেন কি না।
২। সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী সংগঠনসমুহ সমস্যাটি নিয়ে নিয়োগকারী ও তাদের সংগঠনসমুহ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়, আইন মন্ত্রণালয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, এবং অন্যান্য মানবাধিকার, পেশাজীবী ও আইন-সহায়তা সংস্থা প্রভৃতির সঙ্গে সমস্যার ব্যাপকতার উপর আলোচনা ও মতামত গঠন করবে । আইনী দিক পর্যালোচনা করবে।
৩। সমস্যার উপর নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা সম্পাদন ও তা প্রকাশ। এতে সমস্যার আইনী, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্যগত, মনস্তাতিক সকল দিক খতিয়ে দেখতে হবে।
৪। যারা প্রথাগত “শ্রমিক” সংজ্ঞার আওতায় ও তার আওতার বাইরে (কথিত কর্মকর্তা) তারাও শ্রম আদালতের মাধ্যমে ব্যক্তি পর্যায়ে প্রতিকার চাইতে পারেন (শ্রম আইন, ধারা ২১৩)। চাকরীর শর্ত শ্রম আইনের সঙ্গে সংঘর্ষ হলে প্রতিকার চাওয়া সম্ভব।
৫। নিয়োগপত্রে/চুক্তিতে মৌলিক এবং মানবাধিকার-লঙ্ঘনমূলক শর্ত থাকলে মাননীয় হাই কোর্ট বিভাগে রিট পিটিশনের মাধ্যমে তার প্রতিকার প্রার্থনা করা। ব্যক্তি ও দলীয়ভাবে তা করা সম্ভব।
 
শেষ কথা- অনেকে আইনের আশ্রয় নেওয়াকে জটিল ও ঝামেলাপূর্ণ মনে করেন। কিন্তু, আপনি যখন বে-আইনি পদক্ষেপের শিকার, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তখন তার আইনী-প্রতিবাদ না করা কিংবা প্রতিকার না চাওয়ার হ’ল বে-আইনী কার্যক্রম মেনে চলা।
 
তাই আপনার সমস্যা বুঝে এই বিষয়ে অভিজ্ঞ কোন আইনজীবীর পরামর্শ এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
 
লেখক : ড. উত্তম কুমার দাস, এলএল.এম. (যুক্তরাষ্ট্র), পিএইচ.ডি. (আইন); এডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ; শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ। ই-মেইলঃ [email protected]; www.uttamkdas.simplesite.com
 
(মতামত লেখকের নিজস্ব, এর সঙ্গে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক সংশ্লিষ্টতার কোন সম্পর্ক নেই)।