তৌহিদুল ইসলাম চঞ্চল : শ্রেনীগত, পেশাগত, অবস্থানগত দিক বিবেচনা করেই আসলে ক্রয় করতে যাওয়া কেদারার মান ও দাম নির্ণয় করা হয়, তেমনি যে অবস্থানের দিক থেকে যত উপরে তার চারিপাশের সবকিছু ততটা ঠাণ্ডা থাকে। ধরুন, ঠিক এমনি এক দামী আরাম কেদারায় ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে যখন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় শিরোনাম দেখছি, “ প্রচন্ড রোড আর তাপদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন” কিংবা ‘গরমে ছুটি না দেয়ায় অমুক গ্রুপের শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করেছে” অথবা “ অমুক কারখানায় হুট করে শ্রমিকরা গরমের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে”। আমি যেখান বসে আছি সেখান থেকে, সেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ থেকে আসলে গরমের প্রখরতাটা কেমন তা কি অনুভব করা সম্ভব? অনেকে বলবেন সম্ভব না, আমি বলি সম্ভব যদি অনুভব করার মত মন, স্বদিচ্ছা কিংবা সহানুভূতি থাকে তাহলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে বসেও বাইরের তাপমাত্রা অনুভব করা সম্ভব।
একটু আগামী কদিনের আবহাওয়ার বার্তা শুনি, “আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন জেলাসহ প্রায় সাতটি অঞ্চলের ওপর দিয়ে মৃদু দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। তাপমাত্রও বৃদ্ধি পাবে। রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা প্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গেছে। বাতাসে সীসার পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। দু-একদিনের মধ্যে বৃষ্টিপাতের কিছুটা সম্ভাবনা থাকলেও এ অস্বস্তিকর গরম থেকে আপাতত মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না। থাকবে আরও কয়েকদিন। পশ্চিমা লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে, যা উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। যে কারণে দেশের সাতটি অঞ্চলের ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বইছে। এটা আরও বেশ কয়েকদিন অব্যাহত থাকবে। এছাড়া দিন ও রাতের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকবে”।
অপরদিকে প্রচন্ড গরমে আর কোথাও কোথাও দিনে রাতে বৈদ্যুতিক লোডশেডিং এর কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে, মানুষ জ্বর, ডায়রিয়া, শক্তি অবক্ষয় কিংবা দুর্বলতা, হিট স্ট্রোক, চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এখন হয়ত অনেকে চিন্তা করতে পারি গতবারও তো তাপমাত্রা এর কাছাকাছি ছিল! সেক্ষেত্রে বলতে চাই অন্যান্য বার গরমটা যেমন ধীরে ধীরে বাড়ে এবার কিন্তু তা হয়নি এবার একবারে পড়েছে। সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব কিন্তু আমাদের দেশেও পড়ছে।
পোশাক শিল্প শ্রমিকরা যেসব এলাকায় বসবাস করে তা অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা অপরদিকে বৈদ্যুতিক লোডশেডিং তো আছেই, সেক্ষেত্রে এই প্রচন্ড গরমে তাদের রাতে স্বাভাবিক ঘুম হচ্ছেনা তা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। একটানা কয়েকদিন অপরিপূর্ণ ঘুম নিয়ে যখন একটা শ্রমিক কায়িক পরিশ্রম করবে তার অসুস্থ হওয়াটা স্বাভাবিক। এর ফলে কারখানায় শ্রমিকের অনুপস্থিতির হার বেড়ে যাবে আর যা উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে। করবেইতো! সুতরাং উৎপাদন ঠিক রাখতে গেলে প্রথমে আমার শ্রমিকদের শরীর সুস্থ থাকার বিকল্প নেই। মানুষ নিজের ঘরে ফ্যানের নীচে থেকেও যেভাবে দরদর করে ঘামছে সেক্ষেত্রে আমরা যদি আমাদের প্রোডাকশন ফ্লোরের কথা চিন্তা করি বা আমরা জানি সেখানে কেমন গরম রয়েছে! আমরা বলতে পারি যে আমরা গরম বায়ু নির্গমনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করেছি, কারখানায় প্রচুর Exhaust ফ্যান লাগিয়েছি। হ্যা কিন্তু বাস্তবিক তা কতটা কাজে লাগছে? আমরা তো শ্রম আইনের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল আর তাই ২০০০ হাজার এর নীচে শ্রমিক বিশিষ্ট কারখানায় একজন কল্যান কর্মকর্তা নিয়োগ দিই। আসলেই প্রশংসা করার মত বিষয়, কিন্তু ধরি ২০০০ জন শ্রমিকের জন্য একজন কল্যান কর্মকর্তা কি যথেষ্ট? আসুন বাস্তবিক চিন্তা করি। পোশাক কারখানায় যে পরিমাণ এক্সজস্ট ফ্যান থাকে তা প্রয়োজনের তুলনায় কমই। এই গরমে কারখানার প্রোডাকশন ফ্লোরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে কয়েকটি সমস্যা সামনে আসতে পারে যেমন :
১. শ্রমিকরা অসুস্থ হয়ে পরবে
২. শ্রমিকদের অনুপস্থিতি বাড়বে (অসুস্থ হওয়ার ফলে)
৩. ফ্লোরে হয়রানী , খারাপ আচরণ বাড়বে (যেহেতু গরমে মানুষের মাথাও গরম থাকে)
এর ফলে আমাদের কারখানাগুলোর উৎপাদন ব্যহত হবে, পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি হবে যা থেকে যেকোনো অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে! অপর দিকে খোদা না করুন কিন্তু যত তাপ বাড়বে তা অগ্নিকান্ডের সম্ভাবনাকেও বাড়িয়ে দেবে। এখন এক্ষেত্রে শ্রমিকদের সুস্থ রাখতে ও আমাদের কর্ম পরিবেশ ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ফ্লোরের গরম হাওয়া বের করার জন্য প্রয়োজনে অতিরিক্ত Exhaust ফ্যান বা নিজ বুদ্ধিতে অন্য ব্যবস্থা করুন। আমরা অনেক সময় শ্রমিকদের লেবুর শরবত সরবরাহ করি তা একটু নিয়মিত করুন। টিনশেড বিল্ডিং এর তাপ প্রশমনের জন্য আমরা যে ব্যবস্থা নিয়েছি তা আসলেই পর্যাপ্ত কিনা একটু যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। সুপারভাইজারদের বলুন সকালে উৎপাদন শুরুর আগে সকল শ্রমিকদের মুখের দিকে একবার তাকাতে হয়ত তার মন খারাপ, কিংবা অসুস্থ, হতে পারে তার পরিবারে কেউ অসুস্থ। আমরা যারা কর্মকর্তারা আছি তারা পালাক্রমে ফ্লোরে অবস্থান করে শ্রমিকদের খোঁজখবর নিই। কোন প্রকার হয়রানী হচ্ছে কিনা তাও লক্ষ্য রাখি। প্রতি ১.৫ থেকে দুই ঘণ্টা কাজের পর তাদেরকে মুখমণ্ডল পানি দিয়ে একটু ভিজিয়ে নেয়া এবং পর্যাপ্ত পরিমান পানি খাওয়ার বিষয়ে উৎসাহিত করি।
এখন বলতে পারেন যে, মুখ ধোয়ার সময় কোথায়? উৎপাদনের কি হবে? আরে ভাই ক্যাপাসিটি স্টাডি আর এসএমভি করে টার্গেট নির্ধারণের সময় আমরাতো allowance দিয়েছি ১৫ থেকে ২০% , ঠিক কিনা। আবার আপনার এনপিটি দেখুন। এটা কোন বিষয় না। শ্রমিকরা সুস্থ থাকলে উৎপাদন হবে।
সর্বোপরি ফ্লোরের পরিবেশ টা ঠিক রাখা জরুরী। এছাড়াও উৎপাদন শুরুর আগে শ্রমিকদের সাথে যদি ৫/১০ মিনিট কথা বলে তাদের এই গরমে করনীয় বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেন তাও তাদের উপকারে আসবে অথবা পিএ সিস্টেমে ঘোষণা দিতে পারেন (তা আর ক জন শোনে!)। যেমন; শাকসবজি- ফলমূল বেশী খাওয়া, পানি বেশী পান করা, মাঝে মাঝে গ্লুকোজ অথবা স্যালাইন পানি খাওয়া, কালো কাপড় পরিধান থেকে বিরত থাকা, রোদে বের হলে ছাতা ব্যবহার করা, ঢিলাঢালা ও সুতি কাপড় পরতে উৎসাহ দিন । চর্বি জাতীয় খাবার কদিনের জন্য খাওয়া বন্ধ রাখতে বলুন। বেশী বেশী হাত মুখ ধুতে বলুন, নিয়মিত গোসলের পরামর্শ দিন ইত্যাদি।
আরেকটি বিষয় ফ্লোরে অযথা রিজেক্টেড, ত্রুটিযুক্ত কিংবা ওয়াশিং সেকশনে পাঠানো হবে এমন গার্মেন্টস বডি মজুদ করে রাখা উচিৎ নয়। এছাড়া কার্টুন ও অন্যান্য জিনিসতো আছেই। লাইন/ ফ্লোর যতটা সম্ভব খোলা রাখাটাই যুক্তিযুক্ত। সামনে রোজার মাস আসছে। চিন্তার বিষয় আশাকরি এর মধ্যে আবহাওয়ার উন্নতি হবে। শ্রমিকরা কখনোই ঈদের আগের মাসে অনুপস্থিত থাকেনা কারণ তারা এসময় যতটা আয় করবে তাদের জন্য তত ভাল। এ অবস্থাতেও যদি তারা কোথাও কোথাও অসন্তোষ প্রকাশ করে তার নিশ্চয় কোন যৌক্তিক কারণ রয়েছে। কোনো শ্রমিকই কারখানায় অপ্রীতিকর ঘটনা চায় না। কারখানা মালিক ও কর্মকর্তাদেরও শ্রমিকদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। শ্রমিকদের স্বাস্থের প্রতি যত্নবান হতে হবে। যে কোনো শিল্প কারখানার মালিক ও কর্মকর্তাদের মনে রাখতে হবে, “আগে মানুষ তারপর উৎপাদন”। সকলের মঙ্গল হোক।
লেখক : মানবসম্পদ প্রশিক্ষক, সংগীত শিল্পী, ফ্রিল্যান্স লেখক
ইমেইলঃ [email protected]; [email protected]
মতামত লিখুন :