আব্দুল আলিম : বাংলাদেশের পোশাক খাতের অন্যতম প্রধান উপখাত সোয়েটার বা হেভি নিট ইন্ডাস্ট্রি। এই শিল্পের সবচেয়ে কঠোর শ্রমনির্ভর অংশ হল নিটিং। পোশাক খাতের শ্রমিকদের মধ্যে এই নিটিং অপারেটরদের আয় অন্যদের তুলনায় একটু বেশি। তবে হস্তচালিত শিল্পের ন্যায় ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে শ্রমনির্ভর ও শ্রমিকদের একটু বেশি আয়ের এই উৎসটি। এই স্থান দখল করে নিয়েছে অটোমেটিক মেশিন।
একটি সাধারণ মানের জাকারড মেশিন (চায়না)এর পেছনে বিনিয়োগ ১০-১৫ লাখ টাকা যা গড়ে ৫ জন শ্রমিকের সমান কাজ করতে পারে বা উৎপাদন দিতে পারে। যেখানে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকার মেশিন আর সুলভে পাওয়া পাঁচজন অপারেটর একই উৎপাদনক্ষম হতে পারে সেখানে ১০-১৫ লাখ টাকার পুরোটাই আমদানি নির্ভর ও একটি নির্দিষ্ট সময় পরে আর কোন ভাবেই এই মেশিন ব্যবহারযোগ্য থাকবে না।
একটি জাকার্ড/অটোমেটিক নিটিং ৫ জন শ্রমিকের কাজ করে এবং ৮-১০ টি মেশিন চালাতে কেবলমাত্র একজন শ্রমিক লাগে। তাঁর মানে ৪০ থেকে ৫০ জন শ্রমিকের স্থলে এখন এই কাজে লাগছে ১ জন শ্রমিক। বিভিন্ন সময় বড় বড় কারখানা মালিকদের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে তারা বলেন প্রযুক্তির ফলে আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু আবার নেতিবাচক কথাও শোনা যায় অনেক মালিকদের কাছে। তারা মনে করেন এতো বড় বিনিয়োগ করে উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার পর এবার ক্রেতাদের জন্য আরেকটি জায়গা তৈরি হয়েছে । আমাদের দেশে এখন ক্রয়াদেশের চেয়ে সোয়েটার উৎপাদন ক্ষমতা বেশি থাকায় সব সময় কিছুটা উৎপাদন ক্ষমতা অলস থাকে আর সেই সুযোগে ক্রেতারাও দরকষাকষি করতে থাকে আর উৎপাদন ক্ষমতা সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে আমরা কম মূল্যই মেনে নিচ্ছি।
বাংলাদেশে পোশাক খাতের আগমন আর দ্রুত উন্নতির কারন কি কখনও আমরা বিশ্লেষণ করেছি? পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানী করতে যা লাগে তাঁর কি আছে আমাদের? তুলা, সুতা, মেশিনারিজ, এক্সেসরিজ কোনটা আছে আমাদের? আমাদের আছে শুধু মানুষ। আর সেই মানুষের মেধা, শ্রম আর আমাদের পরিবেশ থেকে পাওয়া পানি, গ্যাস, ভর্তুকি দামে পাওয়া বিদ্যুৎ কে সরাসরি বিক্রি না করে প্রক্রিয়াজাত করে পোশাক রপ্তানীর নামে ডলারে পরিণত করছি। এটাই আমাদের পোশাক শিল্প, যেখানে মানুষ আর পরিবেশ ছাড়া সবই আমরা আমদানি করে থাকি। এবার যদি অটোমেটিক মেশিনের মত সেই মানুষের বিকল্প আমদানি করতে থাকি তাহলে বাকি থাকবে শুধু আমাদের পরিবেশ। তাঁর মানে আমাদের পোশাক রপ্তানীর মানে দাঁড়াবে এমন যে, চিন/ভারত/আফ্রিকা/পাকিস্তান থেকে কাঁচামাল, ওই সব দেশের বিশেষজ্ঞ, ইউরোপ/চীন থেকে মেশিন এনে আমাদের আলো, বাতাস, পানি ব্যবহার করে কাঁচামাল থেকে পণ্য উৎপাদন করে আবার ইউরোপ বা আমেরিকাতে পাঠানো, আর আলো, বাতাস আর পানির বিনিময়ে সামান্য কিছু হাদিয়া অর্জন। তবে এসব আমদানী করা মেশিনের দায়বদ্ধতাটাও আমাদের ঘাড়েই থেকে যাবে।
যুগোপযোগী প্রযুক্তির সাথে আমাদের পরিচয় হবে, আমরা আলিঙ্গন করবো সময়ের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে তাতে কোন দ্বিমত না থাকলেও, সেই প্রযুক্তি দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের সুফল দিবে কিনা তা একটু ভাবতে তো হবে। শিক্ষা গ্রহনের কোন আধুনিক প্রযুক্তি যদি আমাদের শিক্ষিত বেকার তৈরিতে সহায়ক হয় সেই প্রযুক্তি যেমন আমরা গ্রহণ করবো না তেমনি আমাদের সবচেয়ে গৌরবের শিল্পখাতে যেকোন প্রযুক্তি উৎসাহিত করার আগে আমাদের নানাদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়াই সমীচীন হবে। শিল্প উদ্যোক্তারা স্বল্পকালীন লাভজনক বিজনেস মডেলকে বেছে না নিয়ে টেকসই ও জাতীয় স্বার্থের জন্য সহায়ক বিজনেস মডেল উদ্ভাবন ও গ্রহণ করবেন বলেই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : সম্পাদক, দি আরএমজি টাইমস
মতামত লিখুন :