আব্দুল আলিম : নব্বই এর দশক থেকে আজ পর্যন্ত অত্যন্ত কম সময়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ভারত ও তুরস্ক কে পেছনে ফেলে চীনের পরের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশে পরিনত হয়। খুব দ্রুত এবং অনেকটা অনিয়ন্ত্রিতভাবে গড়ে উঠা এই শিল্পের সবচেয়ে বড় শক্তি কম মূল্যের শ্রম। অপ্রতুল সরকারি তদারকি ও দুর্নীতির কারনে এই খাতের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও কমপ্লায়েন্স অনেকটা পোশাক মালিকদের ইচ্ছার উপরই নির্ভর করেছে। তবে ২০০০ সালের পর থেকে কমপ্লায়েন্স এর চাপ বাড়তে থাকে এবং বিভিন্ন ধরনের কমপ্লায়েন্স নীতিমালা ও উদ্যোগের আবির্ভাব ঘটে। বিশেষ করে বিএসসিআই, আইসিএস, রাপ ও ওয়ালমার্ট সহ অন্যান্য বড় ব্র্যান্ডগুলির নিজস্ব নীতিমালার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স অডিটের ওপর ব্যাপক চাপ আসে এবং ধীরে ধীরে কারখানাগুলি একটা পর্যায়ে চলে আসে। বাংলাদেশের কমপ্লায়েন্স এর অবস্থা যখন অতীত থেকে অনেক ভাল অবস্থানে ঠিক তখনি ঘটে যায় বিশ্বের অন্যতম দুটি কারখানা দুর্ঘটনা। এক বছরের মধ্যে তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকান্ডের পর রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক নিহত ও অসংখ্য শ্রমিক কর্মকর্তা আহত হন।
কমপ্লায়েন্স নিয়ে আমাদের দেশের কারখানাগুলিতে বেশ আগ থেকেই ব্যাপক চাপ দিয়ে আসছিল বিদেশি ক্রেতারা। যদিও এর মাত্রা ছাড়িয়ে যায় রানা প্লাজা ও তাজরিন ফ্যাশনের দুর্ঘটনার পর থেকে। বাংলাদেশের কারখানাগুলিও ক্রেতাদের সকল চাহিদা পুরন করতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিরাপদ কাজের পরিবেশ তৈরি করতে বিনিয়োগ হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। ক্রেতাদের চাহিদা পুরনে ব্যর্থ হয়ে বা যথেষ্ঠ কাজ না থাকায় ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে শুধুমাত্র বিজিএমইএ এর ঢাকা অঞ্চলের ১১৬৩ টি কারখানা। স্বয়ং বিজিএমইএ এর দেয়া তথ্য মতে আরও ৮৭২ টি কারখানা কোন রকম সাব-কন্ট্রাক্ট করে টিকে আছে, তারা কোন রপ্তানি করছেন না। ৪২৯৬ টি সদস্য কারখানার মধ্যে এখন মাত্র ১৬১৮ টি কারখানা সরাসরি রপ্তানি করছে।
বাংলাদেশের কারখানাগুলি বিভিন্ন কারনে যখন বন্ধ হওয়ার প্রতিযোগিতায় পতিত হচ্ছে ঠিক একই সময় এই খাতে অত্যন্ত অনভিজ্ঞ, কমপ্লায়েন্স এর ক্ষেত্রে আমাদের থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করা মায়ানমার যেন বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আশির দশকে আমাদের দেশের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বললে অনেকেই হেসে উড়িয়ে দিলেও আজ পোশাক খাত সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রুপ দিয়েছে। প্রায় অনেকটা আশি/নব্বই দশকের বাংলাদেশের মতই মায়ানমার এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ৩০০ এর বেশি কারখানা চালু হয়েছে সেখানে যেখানে বাংলাদেশে কয়েক বছরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রায় ১৫০০ কারখানা।
ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন চাহিদা পুরণ করতে যখন বাংলাদেশের কারখানাগুলি বিরাট অঙ্কের অর্থ ব্যয় করছেন তখন আরও সস্তায় পণ্য কিনতে ক্রেতারা কমপ্লায়েন্স এর ধার না ধেরে মায়ানমার বা ইথিওপিয়ার দিকে ঝুঁকছেন। ইতিমধ্যে এইচ অ্যান্ড এম, গ্যাপ সহ অনেক ব্র্যান্ড তাদের পোশাক তৈরি করছেন মায়ানমারে। এই ব্র্যান্ডগুলি কি সত্যিই কমপ্লায়েন্স প্রতিষ্ঠিত করতে চান নাকি কম মূল্যে পোশাক কিনতে চান। যদি বাংলাদেশের কারখানাগুলির কমপ্লায়েন্স ভাল না থাকায় ব্রান্ডগুলি এখানে কাজ করাতে না পারেন তাহলে মায়ানমারে কি সম্ভব? সেখানকার কারখানাগুলি এখনও কমপ্লায়েন্স সমন্ধে তেমন কোন ধারনাই রাখে না। পঞ্চাশ বছরের সামরিক শাসন আর বহুদিনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় থাকার কারনে বহির্বিশ্ব সম্পর্কে তাদের ধারণাও কম। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার প্রয়োজনীয় সকল আইন কানুন এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। ন্যূনতম বেতন কাঠামোও মাত্র কিছুদিন হল প্রবর্তিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে ক্রেতারা এত এত কমপ্লায়েন্স চান, জুড়ে দিচ্ছেন হাজারো প্রশ্ন, সেই তারাই এখানে অনেক নমনীয়। মুলত তারা বাংলাদেশের বিকল্প খুঁজে নিচ্ছেন। কারণ বাংলাদেশ এখন শতভাগ কমপ্লায়েন্স এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর শতভাগ কমপ্লায়েন্স কারখানার খরচ বেশি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এদেশের পোশাক কারখানাগুলি মূল্য বৃদ্ধির চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে ক্রেতাদের উপর। কিন্তু সস্তায় মাল কেনা ক্রেতারা কি আর দাম বাড়াতে চায়? তারা চান আরও কম মূল্যে পোশাক। হয়ত যতদিনে মায়ানমারে রানা প্লাজা বা তাজরীন এর মত ঘটনা না ঘটবে ততদিনই এই সুবিধাবাদী ক্রেতারা থাকবেন মায়ানমার কিংবা ইথিওপিয়া। আবার খুঁজে নিবেন সোমালিয়া, মোজাম্বিকের মত কোন দেশ যেখানে আইনের শাসন দুর্বল তাই নাম মাত্র মূল্যে কেনা যাবে শ্রম।
মতামত লিখুন :