Logo

বোনাসের ক্ষেত্রে শ্রম বিধিতে অসামঞ্জস্যতা, শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা, প্রয়োজন সমন্বয়

Fazlul Haque
শুক্রবার, জুন ২৪, ২০১৬
  • শেয়ার করুন

আব্দুল আলিম : প্রচন্ড গরমের মধ্যে এবারের সিয়াম সাধনার মাস প্রায় শেষের দিকে। সঠিক সময়ে সঠিক মানের পোশাক ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে বুক ফাটা গরম সহ্য করে সিয়াম পালনরত পোশাক শ্রমিক আছিয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টার অপর প্রান্তে ঈদের খুশি লুকিয়ে আছে। তবে আছিয়াদের অভিজ্ঞতা যে সব সময় সুখের নয়।এই লুকিয়ে রাখা খুশি সব সময় চুড়ান্ত খুশিতে পরিনত হয় না। আনন্দের এই দিনটিকে ঘিরে আমাদের প্রিয় পোশাক খাত মাঝে মাঝেই অস্থির হয়ে উঠে ঈদের আগে বেতন বোনাসকে কেন্দ্র করে। যাদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির মুল চালিকা শক্তি এই পোশাক খাত এগিয়ে যাচ্ছে সেই শ্রমিক, কর্মচারি, কর্মকর্তাদের সারা বছর থাকে না কোন ফুসরত, থাকে না কোন আনন্দ উল্লাসের সুযোগ। সারা বছরে পরিবার নিয়ে আনন্দ উল্লাসের পরিকল্পনা থাকে দুটি ঈদকে ঘিরে। আর সেই পরিকল্পনা সব সময় ঘিরে থাকে এক শঙ্কা আর তা হল সময়মত বেতন-ভাতা না পেয়ে বাড়ি যাওয়ার পরিবর্তে রাস্তায়, ভাল খাবারের পরিবর্তে না খেয়ে রোদে পুড়ে ক্ষোভ প্রদর্শনের এক পরিচিত ভয়।

এতদিন ঈদ বোনাস আইনত বাধ্যতামূলক না থাকায় ভিন্ন ভিন্ন কারখানা ভিন্ন ভিন্ন নীতিতে বোনাস প্রদান করে এসেছেন। স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন ভিন্ন নীতির জন্য দ্বিধান্বিত হয়ে পরে শ্রমিকরা। যে সকল কারখানার সিদ্ধান্ত শ্রমিকদের পছন্দ হয় না তারাই নেমে আসে রাস্তায়, শুরু হয় আন্দোলন। শুধু তাদের কারখানা নয় আক্রান্ত হয় অন্য কারখানাগুলোও। এই সুযোগে আখের গোছায় একটি সুবিধাভোগী শ্রেনী। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখেই শ্রম বিধি প্রণয়নের সময় এই বিষয়টা পরিস্কার করে দেয়ার দাবি ছিল। আর এ জন্যই বাংলাদেশ শ্রমবিধি ২০১৫ এর ধারা ১১১(৫) এ উৎসব বোনাস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু বিধিটিতে বোনাস পাওয়ার যোগ্যতার শর্তটি স্বাভাবিক হলেও বোনাসের পরিমাণের শর্তটি শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার্থে নাকি অন্য কারো ইচ্ছার প্রতিফলন, নাকি অনিচ্ছাকৃত ভুল তা বুঝা বড় দায়। কিন্তু বিধির এই সীমাবদ্ধতার সুযোগে শ্রমিক ঠকানোর পাঁয়তারা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে।

বিধি অনুযায়ী চাকরির সময়কাল এক বছর পূর্ণ হলেই একজন শ্রমিক এই বোনাসের আওতায় আসবেন। প্রতিটি সুবিধা প্রাপ্তির যেমন কিছু শর্ত থাকে এটিও তেমনি একটি শর্ত। তবে পূর্বের প্রচলিত চর্চায় আমরা লক্ষ্য করেছি যে এক বছর/ছয়মাস/তিনমাস বিভিন্ন মেয়াদের শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন পরিমানের বোনাস নির্ধারণ করে অনেক কারখানাই সকলের ঈদ আনন্দের কথা চিন্তা করেছেন। তবে এখন বিষয়টি আইন দ্বারা নির্ধারিত তাই এক বছর পূর্ণ না হলে কেউ আর এই বোনাসের আওতায় আসবে না।

বিধি অনুযায়ী বোনাসের পরিমাণ মাসিক মুল মজুরির অধিক হইবে না। আমরা যারা আমাদের প্রয়োজনে শ্রম আইন/বিধি পড়ি তারা নিশ্চয়ই বিধির এই শর্তকে স্বাভাবিক বলতে পারি না। শ্রম আইন বা বিধি শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষায়ই মুলত প্রণীত হলেও এই শর্তটি শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করতেই ব্যবহৃত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছি।

সেদিন কথা হচ্ছিল দেশের অন্যতম প্রধান পোশাক শিল্প গ্রুপের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সাথে। কথায় কথায় বোনাসের কথা বলতেই তিনি বললেন, আইনের বাইরে আমরা যাব না। আরেকটু বিস্তারিত জানতে চাইলে জানান উনারা মোট মজুরির ৫০ শতাংশ হারে বোনাস দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেক কারখানা মুল মজুরির সমান হারে বোনাস দিবেন। তাঁর মানে সারা দেশের কারখানাগুলি একই নিয়মে বোনাস দিবে না। আবার আরেকজন বললেন আমরা পূর্বের মতই এক বছর পূর্ণ করা শ্রমিকদের মুল মজুরির ১০০% হারে এবং বাকিদের চাকরির বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন ধাপে বোনাস দিব। তাঁর মানে স্বতন্ত্র একটি কাঠামো প্রনয়নের জন্য বিধিতে বোনাস নিয়ে আসার আমাদের আশা দুরাশাই রয়ে গেল। এ বিষয়ে কথা হয়েছিল প্রথিতযশা এক কমপ্লায়েন্স অডিটরের সাথে। তিনি মনে করেন বিধিতে যে শর্ত দেয়া হয়েছে বোনাসের পরিমাণ নিয়ে তা সম্পূর্ণ উল্টো হওয়ার কথা ছিল। তিনি এটাকে প্রিন্টিং এর ভুল মনে করে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রতি সংশোধনের আবেদন জানান।

শ্রমবিধিতে বোনাস নিয়ে অসামঞ্জস্যপূর্ণ শর্ত নিয়ে কোন কথা না বললেও ১৫ থেকে ২১ রোজার মধ্যে সকল কারখানা বোনাস প্রদান এবং ঈদের আগে জুন মাসের বেতন প্রদানের আশ্বাস দিয়েছিলেন সরকারের মন্ত্রি।এ ঘোষণা কারখানার মালিকদের সাথে আলোচনা করে যৌথ ঘোষণা হলে অবশ্যই আমরা এর সুফল পাব বলে আশা করি তবে সেই সমন্নয় না হলে আর ঘোষণার জন্য ঘোষণা দিয়ে বসে থাকলে ঈদের আগে উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে আমাদের এই পোশাক খাত।

আমাদের সরকার, সরকারযন্ত্রের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, মালিক ও দেশের সকল জনগণকে বুঝতে হবে, যে শিল্পের বদৌলতে আজ আপনার আমার অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে, সেই শিল্পটি এখন ধুঁকছে। সেই শিল্পটি এখন নানা দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে। ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে হাজারো কারখানা। এই সেদিনও মাননীয় বাণিজ্য মন্ত্রী প্রায় ৮০০ কারখানা বন্ধ রয়েছে বলে জানালেন। তাই শান্তিপূর্ণ শ্রম পরিবেশ রক্ষা করা জন্য অত্যন্ত জরুরী।

অ্যাকর্ড/এলায়েন্স/বিদ্যুৎ সঙ্কট/ গ্যাস সঙ্কট/বিদেশী বায়ারদের শোষণ/প্রতারনা সহ বহু কারনেই বসে যাচ্ছে কম পুঁজির ছোট ছোট কারখানা মালিক। দিতে পারছেন না বেতন-ভাতা আর এরই ধারাবাহিকতায় প্রায় প্রতিদিন বন্ধ হচ্ছে কোন না কোন কারখানা। প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন কারখানায় চলছে বেতন-ভাতার আন্দোলন। যেমন গত ২০ জুন নারায়ণগঞ্জে বেনেটেক্স নামক কারখানার শ্রমিকরা মে মাসের বেতন যথাসময়ে প্রদান না করায় বেতন-ভাতার দাবিতে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। একই অবস্থা একই এলাকার অন্যতম বৃহৎ সোয়েটার কারখানা “টাইম সোয়েটার” কারখানার। মে মাসের বেতন যারা দিতে পারছেন না, এর ওপরে কাজ বন্ধ থাকে তবে বেতন-বোনাস দিতে যে তারা হিমশিম খাবেন এটাই স্বাভাবিক। আর পবিত্র ঈদকে সামনে রেখে সেই শঙ্কা যেন বেড়েই চলছে।

ইতিমধ্যে সরকার বেতন-বোনাসের দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষ হতে পারে এমন প্রায় ৩৫০ কারখানা চিহ্নিত করেছেন। শিল্প পুলিশের হিসাবে  দেশে সব খাত মিলিয়ে শিল্প-কারখানা আছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বলা হলেও সংখ্যাটি আরও বড়। এর অধিকাংশই পোশাক কারখানা। শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোর মধ্যে আছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, আশুলিয়া ও চট্টগ্রাম। পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠন বিজিএমইএর হিসাবে পোশাক কারখানার সংখ্যা ৪ হাজার ২৯৬। সরকার পক্ষের দুটি পৃথক তালিকা অনুযায়ী, মোট ৩৫৮টি কারখানা আছে, যেগুলোয় বেতন-ভাতা নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের ঝুঁকি রয়েছে।

এই মুহূর্তে আমাদের পোশাক খাত উত্তপ্ত হয়ে উঠলে ভয় হয় আবার কোন উপনিবেশিক বার্তা এসে পৌঁছে এই পোশাক খাতের অশনি সঙ্কেত হয়ে।আমরা ঈদের মাঝে হাসির বদলে রাস্তায় নেমে শ্রমিকের কান্নাও দেখতে চাই না, সেই কান্নাকে পুঁজি করে দেশীয় স্বার্থান্বেষীদের স্বার্থ হাসিল হোক সেটাও চাই না। চাই শ্রমিক অধিকারের তকমা নিয়ে আর কোন বিদেশী শক্তি এসে আমাদের ঘাড়ের উপর ছড়ি না ঘোরাক। চাই সমস্যা সমাধানে সরকার, মালিক ও শ্রমিক পক্ষের ইতিবাচক সমন্বয়। ঘটনা ঘটার পরে নয় সমন্বয়ের উদ্যোগ দেখতে চাই এখনি, আর সেই উদ্যোগের শুরুটা করতে হবে সরকারকেই।

লেখক : সম্পাদক, দি আরএমজি টাইমস

ই-মেইল : [email protected]