আব্দুল আলিম : পশ্চিমা পোশাক ব্র্যান্ডগুলির পোশাক তৈরির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঞ্চল এশিয়ার কয়েকটি দেশ।বাংলাদেশের মত প্রতিটি পোশাক রপ্তানীকারক দেশে শ্রমিকদের অধিকার ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ। আর ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বা ব্র্যান্ড এসব নিয়ে কখনও চিন্তা করে না। তারা চিন্তা করে তাদের মুনাফার কথা। যতদিন আমরা তাদের কাছে সস্তায় পোশাক বিক্রি করতে পারবো ঠিক ততদিনই তারা আমাদের কাছ থেকে পোশাক ক্রয় করবে।
কোটি টাকায় ট্রিটমেন্ট প্লান্ট করেছি কিন্তু খরচ কমাতে রাতের অন্ধকারে কেমিক্যালযুক্ত পানি ছেড়ে দিচ্ছি বাইপাস লাইনে। যা হবার তাই হল, পরিবেশকে হত্যা করলাম। কিছু অর্থ খরচ করলাম, বায়ার একই দামে পণ্য পেল আর সবাইকে বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াতে পারলো আমার সরবরাহকারী পরিবেশ দূষণ করে না। এই পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী কে? নিশ্চয়ই কারখানা মালিক, তবে প্ররোচনার দায় কি এড়াতে পারবে ব্র্যান্ড? ফাঁসির প্ররোচনায় যদি খুনের বিচার হতে পারে তবে ব্র্যান্ডকে কেন আমরা কাঠগড়ায় উঠাতে পারব না?
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন এই শিল্প প্রায় সকল দেশে কম বেশী থাকলেও রপ্তানী বাণিজ্যের ধারনা এই শিল্পে জনপ্রিয় হয়ে পড়ার মুল কারন ছিল উৎপাদন খরচ। যেহেতু এই শিল্পটি শ্রমিক নির্ভর, তাই উৎপাদন খরচের বড় একটি অংশ জুড়ে থাকে বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি। যে দেশে নাগরিক সুবিধা বেশী, মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বেশী, আইনের শাসন সুউচ্চ পর্যায়ে সেই সব দেশের একজন শ্রমিক নিয়োগ করা মানে বিরাট দায়বদ্ধতা মাথায় তুলে নেয়া। সেই দিক বিবেচনা করেই উন্নত দেশগুলি আমাদের মত অনুন্নত ও সস্তা শ্রমিকের দেশ খুঁজে বের করে যেখানে আইনের শাসন দুর্বল, যেখানে নাগরিক অধিকারগুলো সংরক্ষিত নয়।
পুঁজিবাদের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে পোশাক ব্যবসা হয়ে উঠে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যবসা। গড়ে উঠে বিশাল নামি দামি ব্র্যান্ড। ঘটে বিশাল ফ্যাশন বিপ্লব। শ্রমনির্ভর হওয়ার কারনে এই শিল্পে সারা দুনিয়ায় সৃষ্টি হয় কোটি কোটি কর্মসংস্থান। শুধুমাত্র বাংলাদেশে সরাসরি শ্রমিকের সংখা ৪০ লাখের বেশি যা এককভাবে সবচেয়ে বড় শ্রম বাজার। এই সেক্টরের সাথে জড়িত আরও প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। আমরা সাদরে গ্রহণ করেছি এই শিল্পকে। আমরা মনে করি আমাদের ধুঁকতে থাকা নড়বড়ে অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে এই গার্মেন্টস সেক্টর। তাইতো বিদেশি ক্রেতাদের প্রভুর মত ভক্তি করে আমরা সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে স্বল্প খরচে পোশাক বানিয়ে দিচ্ছি তাদের চাহিদা মত।
কালের আবর্তে আমরা যখন উন্নয়নের বিভিন্ন মাপকাঠিতে এগিয়ে যাচ্ছি, আমাদের শ্রমিকদের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে কারন তারা জীবনমানের পরিবর্তন অনুভব করছে। আজ দাবি উঠেছে শ্রমের মূল্যবৃদ্ধির। আমরা শিল্পকে যখন আলিঙ্গন করেছি তখন বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পেরেছি সারা দুনিয়ার ফ্যাশন চাহিদা মেটাতে গিয়ে আমাদের পরিবেশ স্থায়ীভাবে ধ্বংস হতে চলেছে। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে এখনও সন্তান গর্ভে ধারণ করে মা থাকে দুশ্চিন্তায়, তার সন্তান বিকলাঙ্গ হবে না তো? তেমনি হয়তো আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের কৃতকর্মের জন্য হবে ভুক্তভোগী। আজ প্রশ্ন উঠেছে পরিবেশ বাঁচানোর। রঙ-বেরঙ এর ফ্যাশন মেটাতে ব্যবহার করা হয় শক্তিশালী কেমিক্যাল। সাদা চামড়ার পশ্চিমা প্রভুদের ত্বকের যাতে ক্ষতি না হয় সেটা নিশ্চিত করতে আমরা নানা পরিক্ষা নিরীক্ষা করি কিন্তু আমাদের মাটি, পানি, বাতাস নির্বিচারে রক্তাক্ত (দূষণ) করি।
আন্দোলন শুরু হয় বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে। মালিক-শ্রমিক-সরকার বসে নতুন বেতন-ভাতা ঠিক করে। কিন্তু ব্র্যান্ড দাম বাড়াতে রাজি হয় না। হুমকি আসে অন্যত্র অর্ডার সরিয়ে ফেলার। যারা কমে করবে অর্ডার চলে যাবে তাদের কাছে। তাহলে ব্র্যান্ড কি আসলে চায় শ্রমিকরা তাদের ঘামের ন্যায্য মূল্য পাক নাকি চায় সস্তা পোশাক? কারখানা মালিককে ব্যবসা করতে হবে তাই উপায়ান্তর না দেখে ছুটেন সরকারের কাছে। সেখানে ব্যর্থ হয়ে শুরু করে দেন খরচ কমানোর অস্ত্রোপাচার। পোশাকের মানের কোন ঘাটতি হলে বায়ার সেই পণ্য নিবে না তাই মানে কোন আপোষ না করে খরচ কমানোর রাস্তা খুজতে হবে। অনেক ঘেটেঘুটে দেখা যায় অসহায় অশিক্ষিত শ্রমিককে ঠকানোটাই সহজ। এটা বলা যাবে না যে মালিকরা ধোঁয়া তুলসি পাতা তবে তারা শ্রমিক ঠকাতে প্ররোচিত হন ব্র্যান্ড থেকেই।
একইভাবে টেকসই উন্নয়নের কথা আসলেই আসে খরচের হিসাব। কাপড় রঙ করতে যে খরচ, সেই রঙ এ লুকিয়ে থাকা কেমিক্যাল পানি থেকে আলাদা করতে খরচ আরও বেশী। বায়ার রঙ করার টাকা দিলেও কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট এর খরচ হয়ে যায় গৌণ। আমরা শুরুতে নির্বিচারে নদী বা খালে ছেড়ে দিয়েছি কেমিক্যাল মিশ্রিত তরল বর্জ্য।নিজের বিবেকের তাড়নায় নয়, দেশ বিদেশের পরিবেশবাদীদের চাপে এখন বিবেকবান হতে বাধ্য হয়ে ট্রিটমেন্ট প্লান্ট করেছি। খরচ এখন বেড়েছে অনেক কিন্তু বায়ার তো দাম বাড়াতে প্রস্তুত নয়। প্রতিযোগিতার যুগে যখন নতুন নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কারে দাম কমছে সেখানে আমাদের কেন বেশি দিবে। কোটি টাকায় ট্রিটমেন্ট প্লান্ট করেছি কিন্তু খরচ কমাতে রাতের অন্ধকারে কেমিক্যালযুক্ত পানি ছেড়ে দিচ্ছি বাইপাস লাইনে। যা হবার তাই হল, পরিবেশকে হত্যা করলাম। কিছু অর্থ খরচ করলাম, বায়ার একই দামে পণ্য পেল আর সবাইকে বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াতে পারে আমার সরবরাহকারী পরিবেশ দূষণ করে না। এই পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী কে? নিশ্চয়ই কারখানা মালিক, তবে প্ররোচনার দায় কি এড়াতে পারবে ব্র্যান্ড? ফাঁসির প্ররোচনায় যদি খুনের বিচার হতে পারে তবে ব্র্যান্ডকে কেন আমরা কাঠগড়ায় উঠাতে পারব না?
জানি আমরা পারব না, যেমন আমার বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলতে পারে না আমার গ্রামের অসহায় কোন গরীব লোক। যারা গেল গেল, বায়াররা চলে গেল বলে উচ্চবাচ্য করেন তাদের বুঝতে হবে, কোন বায়ার আমাদের দয়া কিংবা করুণা করছে না। তাদের স্বার্থেই এসেছে আর যখন স্বার্থ শেষ হবে এমনিতেই চলে যাবে। আমাদের আজকের এই সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে পোশাক রপ্তানির যেমন অবদান আছে তেমনিভাবে আমাদের ঠকিয়েই পশ্চিমারা সস্তায় ফ্যাশন করে বেড়াচ্ছে। তারা মানবাধিকার বলে গলা ফাটিয়ে ফেলবে কিন্তু আমাদের শ্রমের মূল্য দিবে না। ভিক্ষা দিয়ে আমাদের ভিক্ষুকের জাতি বানিয়ে রাখবে কিন্তু অধিকার দিয়ে মাথা উঁচু করার সুযোগ দিবে না।
শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বের পোশাক খাতের শ্রমিকরা শোষিত, নিপীড়িত ও নিগৃহীত। সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপে ভারত, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া সহ নানা দেশের শ্রমিক নির্যাতন নিপীড়নের যে ভয়ংকর চিত্র ফূটে উঠেছে তা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক নাজুক। পোশাক শিল্পে প্রতিষ্ঠিত এই দেশগুলোর যখন এই অবস্থা তখন ব্র্যান্ডগুলি উঁকি দিচ্ছে মায়ানমার, ইথিওপিয়ার মত দেশে যেখানে আরও সস্তায় পোশাক বানানো যাবে। আবার তারা যখন আমাদের পর্যায়ে চলে আসবে তখন পোশাক বনিকরা নতুন কোন আস্তানা খুজে নেবে। আসলে মানবাধিকার নয় ব্র্যান্ডের চাই সস্তায় পোশাক, অধিক মুনাফা।
লেখক : সম্পাদক, দি আরএমজি টাইমস
মতামত লিখুন :