আব্দুল আলিম : আজকের বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনীতিক উন্নয়ন ও আমাদের উন্নত দেশে পরিনত হওয়ার স্বপ্নের কারিগর যারা তাদের নিয়ে আমাদের ভাবার সময় খুবই কম। আমরা যারা বড় বড় ফাইভ স্টার হোটেলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলরুমে বসে বাংলাদেশের রুপকল্প রচনা করি তাদের মধ্যে এমন লোক পাওয়া ভার যিনি আমাদের সুঁই সুতার কারিগরদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধ্যে সামান্য ধারনা রাখেন। অথচ এই সুঁই সুতার কারিগরদের পুঁজি করেই উঁচু তলার পন্ডিতগণ কল্পনার উন্নত বাংলাদেশের কর্মপরিকল্পনা হাতে নিচ্ছেন।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় কয়েক বছর পর পর শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি আমাদের শ্রমিকদের ন্যূনতম জীবন ধারনের নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বারবার। তারপরও সরকার, শ্রমিক অধিকার আদায়ে সক্রিয় ইউনিয়ন, সরকারি/বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো বাস্তবতাকে মাথায় না নিয়ে শুধু বেতন বৃদ্ধি নিয়ে মাথা ঘামায়। বেতন বৃদ্ধির মুল উদ্দেশ্য যদি হয় শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন তাহলে বেতন বৃদ্ধির চেয়েও বেশি কার্যকর হতে পারে আনুসাঙ্গিক সুবিধাদি বৃদ্ধি।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ি শ্রমিকরা তাদের আয়ের প্রায় ৭০-৯০ শতাংশ ব্যয় করে খাদ্য ও বাসস্থানের যোগান দিতে। ২০১০ সালে ন্যূনতম মজুরী ১৬৬২.৫০ থেকে প্রায় দ্বিগুণ করে ৩০০০ টাকা করা হলেও শ্রমিকদের জীবনযাত্রায় যে তেমন কোন প্রভাব পড়েনি তাঁর প্রমাণ মেলে ২০১৩ সালে আবারও যখন বেতন বৃদ্ধির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠে আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বিশ্বস্ত এই শিল্প খাত। শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে শ্রমিক, মালিক ও সরকার পক্ষের আলোচনায় আবারও প্রায় দ্বিগুণ ৫৩০০ টাকা ন্যূনতম বেতন ধার্য করে নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হয়। দেরিতে হলেও প্রায় সকল রপ্তানীমুখী কারখানাগুলো নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করলেও শ্রমিকের জীবনযাত্রায় তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি তার প্রমাণ আবারও শ্রমিকরা বিভিন্ন সময় ৮০০০ টাকা আবার কখনও ১৬০০০ টাকা পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধির দাবি জানাচ্ছেন।
দেশের চালিকা শক্তিতে পরিণত হওয়া এই খাতের সবচেয়ে বড় শক্তি হল কম দামে শ্রম। অবাস্তব কোন বেতন কাঠামো যেমন আমাদের এই শিল্পকে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে ফেলতে পারে তেমনি আমাদের শ্রমিকদের জীবন যাত্রায় উন্নয়ন ঘটাতে না পারি তাহলেও আমাদের এই শিল্প টেকসই করা সম্ভব হবেনা। হয়ত একদিন ক্লান্ত হয়ে যাবে আমাদের এই মহামূল্যবান শ্রমশক্তি, পরবর্তী প্রজন্ম নিরুৎসাহিত হবে এই শিল্প নিয়ে স্বপ্ন দেখতে, ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে আমাদের এই শিল্প। সেদিন হয়ত আমাদের এই জনসম্পদ হয়ে উঠতে পারে জনসমস্যায়।
এবার আসা যাক কেন বেতন দ্বিগুণ করার পরেও শ্রমিকদের জীবনযাত্রায় কোন উন্নয়ন হচ্ছেনা? কারন খুব সহজ এবং সরল, জানাও আছে আমাদের সকলের। বেতন বাড়বে এমন ইঙ্গিত পেলেই প্রথম যে ভদ্রলোক সামনে আসেন তিনি হলেন বাড়ির মালিক। তারপরের দিন বাজারে গেলে দেখা যায় চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। বাড়ি মালিক এসেছেন ভাড়া বৃদ্ধির খবর নিয়ে আর বাজারে দ্রব্য মূল্যের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি। বেতন বাড়ার আগেই বেড়ে যায় শ্রমিকের খরচ। বাড়তি বেতন পেতে পেতে আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধি। পরের বছর আবার সরকারি বেতন ভাতার উন্নয়নের সুবাদে আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধি। বাড়ির মালিক, বাস মালিকদের আর মুক্তবাজার অর্থনীতির মধ্যসত্ত্বা ভোগীদের পোয়াবারো হলেও শ্রমিকের জীবনযাত্রায় কোন পরিবর্তন আসেনি। আরো হাজারবার বেতন বাড়লেও কোন পরিবর্তন আসবে না। যদি এটা কোন সমাধান হতো তবে কেন ৬ বছরের ব্যবধানে ১৬৬২.৫০ টাকা থেকে ৫৩০০.০০ টাকা হলেও সমাধান হল না?
তাহলে সমাধান কি?১০০ শতাংশ বেতন না বাড়িয়ে বেতনের ২৫ শতাংশ পরিমাণ সুবিধা বাড়ান। শ্রমিক তাদের বেতনের সবচেয়ে বেশী অংশ ব্যয় করে খাবারে ও বাসস্থানে। সরকারি অথবা বেসরকারী অথবা কারখানার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকের এই দুই বড় খরুচে খাতে ভর্তুকিমূলক সুবিধা বাড়ান যার ফল সরাসরি শ্রমিক ভোগ করবে। শ্রমিকের খরচ যখন কম থাকবে তখন আর বেতন বৃদ্ধির জন্য তাদের মাঠে নামতে হবে না। মালিক পাবে তাঁর শ্রম আর শ্রমিক পাবে তাঁর ঘামের সঠিক স্বীকৃতি, বন্ধ হবে মধ্যসত্ত্বাভোগীদের রাজত্ব, ঘুচে যাবে মালিক-শ্রমিকের দূরত্ব, গড়ে উঠবে আমাদের স্বপ্নের উন্নত বাংলাদেশ।
লেখক : সম্পাদক, দি আরএমজি টাইমস
মতামত লিখুন :