Logo

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! দূর্নীতি ঠেকান, আমরা আর রানা প্লাজা চাই না

Fazlul Haque
শনিবার, এপ্রিল ২৩, ২০১৬
  • শেয়ার করুন

খন্দকার যোবায়ের : ২৪ এপ্রিল ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ। সকাল ০৯:৩৫ মিনিট। চারপাশ প্রকম্পিত করে হঠাৎ ধ্বসে পড়লো সাভারের রানা প্লাজা। রানা প্লাজা ধুলিস্মাৎ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে গেছে সোনার বাংলার হাজার মানুষের স্বপ্ন। পরোক্ষ ভাবে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে ওঠা কঠিন আজও। আজ রানা প্লাজায় চাপা পড়া, জীবন্ত মানুষের হাত-পা কুপিয়ে কেটে উদ্ধার করা, বুকের উপরের কংক্রিটের বিম-কলাম সরিয়ে এক একটি প্রাণ বাঁচানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করার গল্প বলব না। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষমের অকাল মৃত্যূতে কি দূর্ভাগ্য নেমে আসে পরিবারে, অনুদান আর সাহায্যের নামে লুটপাট হওয়া বা ভুয়া ক্ষতিগ্রস্থতার কাগজে উত্তোলন করা লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার গল্প আজ বলব না, অলৌকিক কন্যা রেশমা সত্যিই কি ধংসস্তুপের মধ্যে আটকা পড়েছিলো নাকি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের সাজানো নাটক ছিলো তা, সেই বিতর্কে আজ আর নাইবা গেলাম।

]
রানা প্লাজায় নিহতদের স্বজনের আত্মচিৎকার! – ছবি : সংগৃহিত

আজ শুধু কিছু প্রশ্ন করতে চাই। কিছু প্রশ্নের সরাসরি উত্তর জানতে চাই। আমার এই প্রশ্ন গুলো হয়তো পাঠকদেরও। উত্তর পাঠকদেরও দরকার। জানা দরকার কাদের জন্য আমাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। কাদের জন্য আমাদের জীবন্ত শরীর থেকে হাত-পা কুপিয়ে কেটে উদ্ধার করতে হয় হাজার হাজার টন ধংসস্তুপের নিচ থেকে। জানা দরকার নিবীড় ভালোবাসার বন্ধনের গিট কেনো ঢিলে হয়ে যায় এক নিমিষেই। বাংলাদেশের বৃহৎ এই রপ্তানি শিল্পের উপর কেনো  বারবার নেমে আসে বিদেশীদের খরগ।

তৈরি পোশাক শিল্প আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বলতে গেলে আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সাহস আসে এই রপ্তানি থেকে অর্জিত অর্থেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ নিজেদের অর্থেই পদ্মা সেতুর মতো বিশাল বাজেটের সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয়ার সাহস পান এই শিল্প থেকে অর্জিত অর্থের কারনেই। আজ শুধু শিক্ষিতরাই নয়, গ্রামের হাজার হাজার অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত জনগোষ্ঠিও অবদান রাখছে জাতীয় অর্থনীতিতে। মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে বাংলাদেশ, যার মোট অবদানের বড় অংশই তৈরি পোশাক শিল্পের।

রাজনীতি যাই হোক, দেশ এগিয়ে যাবে। যাদের নিরলস পরিশ্রমে দেশ হবে ডিজিটাল, তাদেরও হবে উন্নতি। রানা প্লাজা রাজনীতির ঝাঁকুনিতে ভেঙ্গে গেলেও মনে করেছিলাম, সেই ঝাঁকুনি একদিন থেমে যাবে। নতুন করে আর কেউ নাড়িয়ে দেবেনা। নিত্যান্ত বিচারহীনতায় দেশ চলছে তা বলবনা। তবে ভেবেছিলাম, রানা প্লাজার রানাদের বিচার হবে। ১১৩৪ জনকে হত্যার পরে রানারা গ্রেফতার হয়, অথচ তিন বছরেও বিচার হয় না। তদন্তের নামে আমার দেশের শ্রমিক ভাই-বোনদের লাশ নিয়ে আজও চলে প্রহসন। আসামীদের পুলিশ খুজে পায় না। তদন্ত অফিসার পরিবর্তন আর প্রতিবেদনের ফাইলের নিচে চাপা পড়ে যায় আমার নিরন্ন, অবহেলিত শ্রমিকের বুক ফাটা আর্তনাদ। শুনানির পর শুনানি চলতে থাকে বিজ্ঞ আদালতের এজলাসে। অন্ধ আইনের, অন্ধকারে ঢেকে যায় সমাজের নিচু তলার মানুষের লাশের পচা গন্ধ। বিজিএমইএ-ও এক সময় হয়ে যায় মন্থর। আর আমার ভাই-বোনের লাশের ফাইলে উড়ে এসে জমতে থাকে রানা প্লাজা ধসের ধুলো। স্বজন হারা শ্রমিকের ঘামে ভেজা নোটগুলো ঝাড়– দিয়ে পরিস্কার করতে পারেনা সে ফাইল। এবার ফাইলের গতিও হয়ে যায় গতিহীন।

বিজিএমইএ এর একটি মূল শক্তি হলো এই সেক্টরের দক্ষ-অদক্ষ মানব শক্তি। শুধু মেশিন দিয়ে উৎপাদন নিশ্চিত হয়না। এই মানব শক্তির উপর অপ্রত্যাশিত অবিচারের বিরুদ্ধে সংগঠনের প্রতিবাদের ভাষাটি ছিলো কার্যকরী। কিন্তু দিন যাওয়ার সাথে সাথেই পরিবর্তন হতে থাকে সব। ভুলে যেতে থাকে কতটা ব্যাথায় কাতর তার শিল্পের শ্রমিকেরা। কত বিষয় নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রির সাথে বৈঠক করেন বিজিএমইএ এর প্রতিনিধি বা নেতারা। আমি একবারও বলতে শুনিনাই তাদের, হাজার হাজার টন কংক্রিটের নিচে চাপা পড়া আমার শ্রমিকদের হত্যাকারীদের বিচারের কার্যক্রম ত্বরান্নিত করা হোক। আমি একদিনও বলতে শুনিনাই রানা প্লাজার রানাদের বিচারের দাবিতে সকল কারখানায় চলবে ৫ মিনিট কর্ম বিরতি!!! আশা করছি বিজিএমইএ এর পক্ষ থেকে এই বিচার কার্য দ্রুততম সময়ে শেষ করতে তাগিদ দেওয়া হবে।

ফুঠবল বা ক্রিকেট খেলা নিয়ে বিবাদের মত ঘটনায়ও বিরোধীদল হরতাল-ধর্মঘটের ডাক দিতে প্রস্তুত। অথচ হাজার লাশের বিচার দাবিতে তারা একটি স্বারকলিপিও দিতে পারেনা। নিচু তলার ঐ মরে পচে যাওয়া মানুষ গুলোর জন্য ভাবেনা কেউ। বিদেশী কড়া পারফিউমের গন্ধ ছাপিয়ে উঠতে পারেনা লাশের সে গন্ধ। একদিনও তারা বলল না, রানা প্লাজার ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হোক। রাজপথে একদিনও মিছিল হলো না, “আমার ভাই মরল কেনো, প্রশাসন জবাব চাই”।

আজ সরকারি বেশকিছু ভবনে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করা হচ্ছে। রানা প্লাজা ভেঙ্গে পরে বাঙ্গালী জাতির কিছু শিক্ষা হয়েছে ভেবেছিলাম। রডের পরিবের্ত বাঁশের ব্যবহার সেই ধারণায় বাঁশ দিয়ে দিয়েছে। রানা প্লাজা অনুমোদনকারী প্রকৌশলীদের যদি উপযুক্ত বিচার হতো, তবে কেউ হয়ত আর এমন জঘন্য দুঃসাহস দেখাতো না। সরকারের অগোচরেই না জানি আরো কত ভবন গড়ে উঠেছে মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে। না জানি আবার কোন ভবন ধসে পড়ে হারাতে হয় আমার-আপনার আপনজনকে। সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের সঠিক তত্তাবধায়নের অভাব আর সীমাহীন দূর্নীতির কারণে আজ বিদেশী ক্রেতাদের কাছে ক্রমেই ক্রীতদাসে পরিণত হতে বসেছে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প। বিদেশী ক্রেতাগোষ্ঠী আমাদের দূর্নীতির সুযোগ নিয়ে আমাদের কষ্টার্জিত অর্থই নিয়ে যাচ্ছে নানা কৌশলের মাধ্যমে।

ব্যক্তিগত ভাবে আমার অপছন্দের একটি বিষয় হলো, প্রায় এই ধরণের সকল ঘটনার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করতে হয়। তারপর যথাযথ নির্দেশনা নিয়েই কাজ শুরু করেন সংশ্লিষ্ট দপ্তর। আমি যদিও বিষয়টাকে সমর্থন করিনা, তবুও দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার কার্য সম্পন্ন করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আরো কার্যকরী পদক্ষেপ আশা করছি। আশা করছি তীব্র প্রতিবাদের মোকাবেলার প্রেক্ষিতে নয়, নিত্যান্ত আইনগত ও মানবিক কারণেই দ্রুত শেষ হবে রানা প্লাজা ধসের নেপথ্যে জড়িতদের।

এই লেখাটি লিখতে গিয়ে যে আবেগ আমাকে ছুয়েগেছে বারবার, তা সকল সাধারনের মাঝে ছড়িয়ে যাবে এটাই আমার প্রত্যাশা। নিতান্ত মানবিক আর আন্তরিকতায় রানা প্লাজার রানাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। যেনো আর কেউ সাহস না করে রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে কোন স্থাপনা গড়ে তুলতে। সাহস না করে রানা প্লাজার মত অপরিকল্পিত কোন ভবন গড়ে তোলার। তাহলেই নিরাপদ হবে আমার-আপনার জীবন আর সোনার বাংলার অর্থনীতির চলমান চাকাতে প্রাণ সঞ্চার হবে অদম্য গতি।

সর্বশেষে রানা প্লাজায় নিহত আমার সকল শ্রমিক ভাই-বোনদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি স্বজন হারা শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি।

ইমেইলঃ [email protected]