ড. উত্তম কুমার দাস, এডভোকেট: আমার বর্তমান পেশাগত কাজের বড় অংশ শ্রম আইন নিয়ে। আমরা (আমি এবং আরও ক’জন আইনজীবী সহকর্মী মিলে) গত প্রায় এক বছর ধরে বিনা খরচে (প্রো-বনো) আইনী পরামর্শ দিচ্ছি। শ্রমিক ও মালিক দু’পক্ষই আমাদের সেবা নিয়েছেন ও নিচ্ছেন। এছাড়া ফেসবুকসহ আরও কিছু মাধ্যমে আমরা নিয়মিত লিখছি।
এসব কাজের সুবাধে আমাদের নানামুখী অভিজ্ঞতা হচ্ছে। তার আলোকেই এই লেখা। তবে এর উদ্দেশ্য কাউকে সমালোচনা করা নয়, বরং উদাহরণের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি।
প্রথমেই লেখা সম্পর্কে আসি। আমাদের লেখা এত সাড়া দিবে তা ভাবিনি। শুরুতে আমার লেখা দেখে এক আইনজীবী বন্ধুতো মন্তব্যই করে বসলেন- এসব লেখার দরকার কি! নীলক্ষেত থেকে আইনের বই কিনে পড়লেই হ’ল।
আমার বন্ধুকে কিছু বলিনি। তবে নীরবে হেসেছি। আমার ঐ বন্ধু হয়ত জানেনই না যে রাস্তার ওপারে নিউ মার্কেটেও আইন বই পাওয়া যায়। সেখানে আমাদের দেশীয় বইয়ের পাশে অন্য দেশের বইও পাওয়া যায়। কোন বিষয়ের নানান দিক জানতে তাও দরকার।
এখন আমরা ফেসবুকে কোন লেখা দিলে ২-৩ দিনে ২০০০০ থেকে ২৫০০০ পাঠক তা দেখেন। মেসেস পাঠিয়ে বা ফোন করে মতামত দেন, প্রশ্ন করেন, উৎসাহ দেন। আর কি চাই!
গত ছয় মাসে আমরা শ্রম আইন নিয়ে অন্ততঃ ১২ টি প্রশিক্ষণ-কর্মশালা করেছি। সৌভাগ্য দেশের স্বনামখ্যাত প্রতিষ্ঠান আমাদের ডেকেছে। এসব করে কমপক্ষে ৩৫০ মানুষের সংস্পর্শে এসেছি- যারা হয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা বা মানব সম্পদ কর্মকর্তা অথবা ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত ভাই-বোন।
তাঁদের কাছ থেকেও আমাদের শেখা অপরিসীম। তাঁরা আমাদের সামনে যে বিষয় বা সমস্যা তুলে ধরেছেন তা আমাদের জানতে, পড়তে ও শিখতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। অনেক সমস্যার সমাধান তাৎক্ষণিকভাবে না দিলেও পরে দিয়েছি।
এবার অন্যান্য বিষয়ে আসি। এইক্ষেত্রে আমরা যারা চাকরী করেন এবং যারা চাকরী দেন- এমন দুই পক্ষের কথাই বলবো। সমস্যা দু’দিকেই- যা আমরা প্রতিনিয়ত দেখি।
চাকরীর ক্ষেত্রে যারা ভুক্তভোগী তাঁদের ভোগান্তি এবং সমস্যার মধ্যে এক সাধারণ মিল দেখি- সে গার্মেন্টস কারখানায় বে-আইনিভাবে চাকরী হারানো হতদরিদ্র অপারেটর বোন হোক কিংবা পরিচালকদের দ্বন্দে চাকরীচ্যুত বেসরকারী ব্যাংকের সম্মানীয় উপ- ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহেব হোন না কেন।
যারা চাকরী করেন তাঁদের সাধারণ সমস্যা হ’ল- কোন শর্তের উপর তাঁরা চাকরীতে যোগ দিলেন চাকরী করার দিনগুলিতে তা খেয়াল করেন না। এক্ষেত্রে অন্যায্য শর্ত থাকলেও তাঁরা তা মেনে নেন বা বাধ্য হয়ে তাতে স্বাক্ষর করেন (তখন অবশ্য অন্য পথও থাকেনা- চাকরী তো দরকার)।
অনেক ক্ষেত্রে চাকরীর দিনগুলিতে তাঁরা না অধিকার না দায়-দায়িত্ব কোন বিষয়েই তেমন সচেতন থাকেন না।
অবশ্য সকলেই এমনটি করেন তা কিন্তু বলছি না। অনেকেই বিনা কারণে এবং বে-আইনীভাবে তাঁর জন্য মুল্যবান চাকরী হারান। আর তখনই হয় সমস্যা।
স্বনামখ্যাত এক গার্মেন্টস কারখানার এক জেনারেল ম্যানেজার যিনি ২২ বছর চাকরী করেছেন। গত জুন মাসে তাঁর বস মুখের কথায় তাঁকে কারখানা থেকে বের করে দিয়েছেন অর্থাৎ মৌখিক টার্মিনেশন করেছেন, যা বে-আইনি। আমরা যখন তাঁকে পরামর্শ দিতে গেলাম দেখা গেল তাঁর কোন নিয়োগপত্র নেই। যা না দিয়ে মালিক বা নিয়োগকারী আইন ভঙ্গ করেছেন। বিগত সময়ে তিনি বেশ ক’বার প্রমোশন পেলেও তার কোন কাগজপত্র তাঁর কাছে নেই। রয়েছে অফিসে। অথচ তাঁকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছেনা!
তাই সকল চাকরীজীবীর উচিত চাকরী সংক্রান্ত কাগজপত্রের অনুলিপি বাসাসহ একাধিক নিরাপদ স্থানে রাখা। যাতে প্রয়োজনমত ব্যবহার করতে পারেন।
পরের বিষয়- আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা মনে করলে সে বিষয়ে আপনার অনুযোগ বা আপত্তি ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে করতে হয়। এবং তা লিখিতভাবে। অনেকেই তা জানেন না; জানলেও করেন না।
এই প্রসঙ্গে এক ব্যংকার ভাইয়ের কথায় আসি। তাঁর কাগজপত্রে পরিষ্কার তাঁকে যেভাবে চাকরীচ্যুত বা টার্মিনেশন করা হয়েছে তা যথাযথ হয়নি (এক নাম করা বেসরকারী ব্যাংক)। তাই প্রতিকার সম্ভব। ঘটনা ২০১৬ সনের জানুয়ারী মাসের। ভদ্রলোক তাঁকে বিনা কারণে চাকরীচ্যুতির বর্ণনা দিয়ে ও তার প্রতিকার চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে একাধিকবার আবেদন করেছেন। অথচ তাঁর নিজ ব্যাংকে কোন অনুযোগ দেননি (যা ৩০ দিনের মধ্যে দেওয়া দরকার ছিল)। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে তাঁকে বলা হয়েছে শ্রম আদালতে মামলা করতে। আর তা বলা হ’ল আবেদন করার দেড় বছর পর। শ্রম আদালতে যাওয়ার জন্য অনুযোগ দেওয়া প্রয়োজন ছিল।
আরেকজন একটি বহুজাতিক কোম্পানীতে ১৪ বছর চাকরী করেছেন। কোম্পানী তাঁকে বলেছে, তিনি গ্র্যাচুইটি পাবেন না; কারণ কোম্পানীর নীতিমালায় বলা আছে- গ্র্যাচুইটি পেতে ১৫ বছর চাকরী করতে হবে। কোম্পানীর এমন বিধান বে-আইনী। ২০০৬ সনের ১১ অক্টোবর শ্রম আইন গৃহীত হওয়ার পর এক বছর পূর্ণ হলেই গ্র্যাচুইটি প্রাপ্য [ধারা ২(১০)]। অনেকে এই ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের কথাও বলেন, তাও ঠিক নয়।
অনুযোগের বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য- আগে ধারণা করা হতো যে, যারা চাকরীতে বহাল আছেন কেবল তাঁরাই অনুযোগ দিতে পারবেন।
মাননীয় হাই কোর্ট বিভাগ সম্প্রতি এক রায়ে বলেছেন, যারা চাকরীতে নেই তাঁদেরও চাকরী সংক্রান্ত বিষয়ে কোন অনুযোগ থাকলে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ৩৩ ধারা অনুযায়ী অনুযোগ দিতে পারবেন। এতে প্রতিকার না হলে বা কোন ফল না পেলে শ্রম আদালতে যেতে পারবেন। তবে আবারও বলছি, অনুযোগ দিতে হবে ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে।
অনেক ভাবেন, তিনি প্রথাগত: শ্রমিক না, তাই শ্রম আইনে তাঁর জন্য কোন প্রতিকার নেই। আমাদের মাননীয় হাই কোর্ট বিভাগ এবং আপীলেট বিভাগ একাধিক মামলায় সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, কারও পদবী দেখে নয় বরং তাঁর কাজের প্রকৃতি ঠিক করবে কে শ্রমিক আর কে শ্রমিক নয়। আর এটা শিল্প-কারখানা, প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা, সংবাদপত্র, এনজিওসহ বেসরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এবার মালিকপক্ষের দু-একটি বিষয় নিয়ে কথা বলি- তাঁরা কোথায় কিভাবে ভুল করেন।
ধরুন একটি কারখানার ম্যানেজার পদ-মর্যাদার এক কর্মী তাঁদের এমডি সম্পর্কে ই-মেইলে মানহানিকর কথা বলেছেন এবং তাঁর জন্য তাঁরা ঐ কর্মীর বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে কারণ-দর্শানোর নোটিশও দিয়েছে। ঐ কর্মী নোটিশের জবাব না দিয়ে চালাকি করে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং তাতে পদত্যাগপত্র কার্যকর করতে ৩০ দিনের নোটিশ দিয়েছেন। এর মধ্যে কোম্পানিটি ঐ পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার পরদিন থেকেই কর্মীটি অফিসে আসছেন না।
এইক্ষেত্রে কোম্পানীটির উচিত ছিল পদত্যাগের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া আপাততঃ স্থগিত রেখে আগে অসদাচরণের অভিযোগের সুরাহা করা।
আরেক কোম্পানীর দাবী- তাঁদের এক ড্রাইভার দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ঘটনাস্থলে কোম্পানীর গাড়ি ফেলে পালিয়েছে। এই ক্ষেত্রে কোম্পানীটির উচিত- ঘটনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি বা মামলা করা। পাশাপাশি প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে উক্ত শ্রমিকের (ড্রাইভার) বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার জন্য অসদাচরনের অভিযোগ আনা এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় তা সম্পন্ন করা। অথচ তারা ঐ শ্রমিকের বিরুদ্ধে “বিনা অনুমতিতে ১০ দিনের বেশী অনুপস্থিত” এই অভিযোগ তুলে কারণ-দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। সেখানে দুর্ঘটনার বালাই নেই।
আরেক প্রতিষ্ঠান তাদের এক ডিজিএম (কমপ্লায়েন্স)- এর বিরুদ্দ্বে এই মর্মে অসদাচরণের (দায়িত্বে অবহেলা) অভিযোগ তুলেছে যে তিনি কারখানার বাগান থেকে তোলা শাকসবজি টাটকা অবস্থায় মালিকের বাসায় পাঠাতে “ব্যর্থ হয়েছেন”। অথচ এটা ডিজিএম’র নির্ধারিত কাজের অংশ নয়। মাননীয় জিএম সাহেব যিনি ঐ নোটিশ স্বাক্ষর করেছেন তাঁকে তা কে বুঝাবে!
এক ওষুধ কোম্পানি তাদের এক কর্মীকে চিঠি লিখে পদত্যাগ করতে বলেছে! এতেও স্বাক্ষর করেছেন জিএম, মানব সম্পদ।
এমনটি হচ্ছে কেন? এসব কাজ-কর্ম দেখে বুঝা যায়, যারা এসব কাজ দেখেন বা করেন শ্রম আইনে তাঁদের দখল কতটা।
এর সমাধান কি? শ্রম আইনসহ প্রাসঙ্গিক আইনে স্পষ্ট ও প্রায়োগিক ধারণা। তাই শুধু আইন পড়া কিংবা প্রশিক্ষণ নয়; কারা পড়াচ্ছেন বা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তাও দেখার বিষয়।
আর সাধারণ শ্রমিক ভাই-বোনদের জন্য বলবো- অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আছে যারা বিনা খরচে আপনাকে সঠিক পরামর্শ ও সহায়তা দিতে পারে। আপনার উচিত হবে তাদের সঙ্গে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যোগাযোগ করা।
লেখক : এডভোকেট, সুপ্রীম কোর্ট অব বাংলাদেশ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা থেকে আইনে স্নাতকোত্তর (এলএল. এম.) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন শাস্ত্রে পিএইচ. ডি.। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স কোর্সে অধ্যয়নরত।
ফোন: ০১৭৫৬ ৮৬৬৮১০, ই-মেইল: [email protected]
মতামত তাঁর নিজস্ব; এর সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সংশ্লিষ্টতার কোন সম্পর্ক নেই।
মতামত লিখুন :